ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ২৪

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 7 Jul 2022

1750 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

চব্বিশ.

বাংলাদেশের, বিশেষ করে চট্টগ্রাম-ঢাকার মতো বড় শহর-নগরের, যেসব লোকজন প্রায়শই কলকাতায় আসা-যাওয়া করেন তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের কাছেই এই শহরের ‘নিউ মার্কেট’ একটি অতি পরিচিত ও প্রিয় গন্তব্যস্থল। ঈদের আগে কলকাতার নিউ মার্কেটে বাজার করা এঁদের অনেকেরই অবশ্যকর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কলকাতায় এঁরা থাকতেও ভালোবাসেন নিউ মার্কেটের আশেপাশেই, হাঁটাপথের দূরত্বের কোন হোটেলে। বস্তুত, এই এলাকার বেশ কিছু হোটেল বা গেস্ট হাউজ তাদের ব্যবসায় লাভের জন্য প্রধানত বাংলাদেশ থেকে আগত ‘কাস্টমার’দের উপরেই নির্ভরশীল। ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে কিছু দিন আগে পর্যন্ত করোনা অতিমারীর প্রকোপে যখন দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত কার্যত বন্ধ ছিলো, তখন নিউ মার্কেট এলাকার এই হোটেলগুলি যারপরনাই দুরবস্থায় পড়েছিলো। বছর বারো আগে ঊর্মি ও আমি যখন দক্ষিণ কলকাতার এক সুবৃহৎ আবাসনে বাস করতে শুরু করি, তখন ঢাকায় আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘অত দূরে ফ্ল্যাট নিলে!’ আমরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কোথা থেকে অত দূরে?’ তিনিও সরলভাবেই উত্তর দিলেন, ‘কেন, নিউ মার্কেট থেকে।’ বাংলাদেশী মহিলা ক্রেতারা আবার নিউ মার্কেট ও তার প্রতিবেশী এলাকার অধিকাংশ দোকানিরও খুবই প্রিয় মানুষ, অনেকের সঙ্গেই তাঁদের ভাবি-আপার সম্পর্ক, খাস কলকাতার দিদি-বৌদিদের চেয়েও বোধ হয় বেশী অন্তরঙ্গ। ঈদ বা দুর্গা পূজার সময়ে তো দুই বাংলার উৎসাহী মহিলা ক্রেতাদের ভীড়ের জন্য এই বাজারে ঢুকতে অন্য লোকজনকে হিমসিম খেতে হয়। আমি নিজে তো পারতপক্ষে ঐ সময়ে নিউ মার্কেটের ধারেকাছে যাই না।

দেশকাল নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণীর লোকের কাছে নিউ মার্কেটের বিপুল জনপ্রিয়তা সঙ্গত কারণেই। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত অঞ্চলের যাবতীয় ভোগ্যপণ্যের কোন না কোন রকম নমুনা এই বাজারে পাওয়া যাবেই। মোটরগাড়ি, জাহাজ বা এরোপ্লেন এখানে বিক্রী হয় না ঠিকই, তবে কেউ চাইলে এমনকি বাঘের দুধও হয়তো মিলতে পারে, রসিকতা করে এমনটাই দাবি করেন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ও পৃষ্ঠপোষকরা। এই ‘সব পেয়েছির দেশ’ বাজারের জন্ম-প্রক্রিয়ার শুরু ১৮৭৩ সালে। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, এবং শহরের তথাকথিত ‘রাজার জাত’ ইংরেজ বাসিন্দারা যাতে ‘নেটিভ’ বা দেশী লোকজনের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে তাদের দৈনন্দিন কেনাকাটার চাহিদা মেটাতে পারে সেজন্যই তৎকালীন ক্যালকাটা কর্পোরেশন লিন্ডসে স্ট্রীট ফ্রী স্কুল স্ট্রীট এলাকায় এই বাজার পত্তনের উদ্যোগ নেয়। ঐ সময়ে, এবং তার পরেও অনেক বছর পর্যন্ত, এই দু’টি রাস্তার আশপাশের আরও কয়েকটি রাস্তা ছাড়াও খানিক দূরের ড্যালহৌসী স্কোয়্যার (আজকের বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ), ধর্মতলা স্ট্রীট (লেনিন সরণি), চৌরঙ্গী রোড (জওহরলাল নেহ্রু রোড) সংলগ্ন বেশ বড়সড় একটা এলাকা সাহেবপাড়া বলেই পরিচিত ছিল। এই নতুন বাজারের নক্শা রচনার ভার দেওয়া হয় ঈস্ট ইন্ডিয়ান রেইলওয়ে কম্প্যানীর সঙ্গে যুক্ত রিচার্ড রস্কেল বেইন নামে একজন স্থপতিকে এবং তাঁর রচিত ভিক্টোরিয়ান গথিক নক্শা অনুসারে সুপ্রশস্ত বাজার নির্মাণ করার কাজ শুরু করে ম্যাকিন্টশ বার্ন নামের প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় দেড়শ’ বছরের প্রাচীন এই প্রকৌশলী সংস্থা আজও নিয়মিত কাজ করে চলেছে। ১৮৭৪ সালের ১ জানুয়ারী তারিখে জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই বিশাল বাজার ইংরেজ ক্রেতাদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এটাই ছিল কলকাতার প্রথম মিউনিসিপ্যাল মার্কেট বা পুরসভার মালিকানাধীন বাজার। এই বাজার খোলার খবর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং কলকাতার ক্রেতারা তো বটেই, দেশের নানা প্রান্তের অবস্থাপন্ন লোকজনের ভীড়ে বাজার চত্বর গমগম করতে লাগলো। ঐ সময়ের বেশ কয়েকটা নামকরা বিলেতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও, যেমন পোষাক নির্মাতা র‌্যাংকিন অ্যান্ড কম্প্যানী, অভিজাত মহিলা-পুরুষদের জুতো সরবরাহকারী কাথবার্টসন অ্যান্ড হার্পার, দামি স্টেশনারী সামগ্রীর দোকান আর. ডাব্লিউ. নিউম্যান, পুস্তক বিপণি থ্যাকার-স্পিংক, নতুন বাজারে জমিয়ে বসলো। ভারতীয় বা বাঙালিরা যে একেবারেই এই বাজারে ঢুকতে পারতো না তা নয়, তবে প্রবেশাধিকার তখন প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল ধনী, সাহেবদের নেকনজরে থাকা সম্প্রদায়ের মধ্যেই, তাছাড়া এখানে কেনাকাটা করার সঙ্গতিও দেশী লোকজনের মধ্যে ক’জনেরই বা ছিলো। নিউ মার্কেটের সেই কৌলীন্য এখন অবশ্য আর নেই। উচ্চবিত্তদের আনাগোনা বন্ধ হয়নি বটে, কিন্তু মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্তদের জন্যও বাজার অনেক দিন ধরেই অবারিতদ্বার।

ক্যালকাটা কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্যার স্টুয়ার্ট হগ এই নতুন বাজার তৈরীর পরিকল্পনা অনুমোদন ও কার্যকর করায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরই সম্মানে বাজার চালু হওয়ার আঠাশ বছর পর, ১৯০৩ সালের ২ ডিসেম্বার তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম দেওয়া হয় ‘স্যার স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’, সংক্ষেপে কেবল ‘হগ মার্কেট’, বাঙালিদের মুখে ‘হগ সাহেবের বাজার’। কলকাতার প্রবীণ নাগরিকদের অনেককেই কয়েক বছর আগে পর্যন্তও এই নামটা ব্যবহার করতে শোনা গেছে। ক্যালকাটা কর্পোরেশন বা কলকাতা পুরসভার মূল ভবনের দেওয়ালে টাঙানো প্রাক্তন ও বর্তমান মেয়র এবং অন্যান্য আধিকারিকদের ছবির মধ্যে এখনও রয়েছে স্যার স্টুয়ার্ট হগের প্রতিকৃতি। তবে পোশাকি নাম যাই হোক, বাজার পত্তনের শুরু থেকে ‘নিউ মার্কেট’ ডাকনামটাই সকলের কাছে তার আসল নাম।

নিউ মার্কেটের শ্রীবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে তার জন্মলগ্ন থেকেই এবং তার জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ার কোন লক্ষণ নেই। বাজারের উত্তর দিকের অংশটি নির্মিত হয় ১৯০৯ সালে, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও দক্ষিণ দিকে নতুন অংশ সংযোজিত হয়। এই দক্ষিণ দিকেই ত্রিশের দশকে বাজারের মাথায় বসানো হয়েছিল ইংল্যান্ডের হাডারস্ফিল্ড শহর থেকে নিয়ে আসা ‘ক্লক্ টাওয়ার’। বাজারের সামনের দিকের প্রবেশপথের পাশে ফুল বিক্রেতাদের বসার জায়গা করে দেওয়া হয়, পিছন দিকে খোলা হয় টাটকা ও সংরক্ষিত খাবারদাবারের দোকান, তারপর শাকসব্জির দোকানগুলি পেরিয়ে মাছ ও মাংস বিক্রেতাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা। তারও পরে, বাজারের শেষ প্রান্তে, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল দেশবিদেশের নানা অঞ্চল থেকে আমদানি করা রকমারি পোষ্যের, অর্থাৎ পশু-পাখীর বাজার। দু’চারজন বিক্রেতা এই বাজারে এখনও আছেন। অন্যান্য সব সামগ্রীর দোকানগুলি স্থান পেয়েছে বাজারের বাকি অংশে। নিউ মার্কেটের বাইরের দিকেও, মূল প্রবেশপথের সামনের চত্বরে এবং পাশের দিকের রাস্তার ফুটপাথ জুড়ে অনেক দিন ধরেই হকাররা অগুন্তি ‘স্টল’ সাজিয়ে বসে আসছেন, যেগুলিতে পাওয়া যায় নানা বিচিত্র জিনিষের বিরাট সম্ভার। এইসব দোকানের ক্রেতার সংখ্যাও প্রচুর।

কালিম্পং চীজ

কলকাতা শহরের সমস্ত এলাকাতেই এখন তৈরী হয়েছে ঝকঝকে চেহারার আধুনিক বাতানুকূল দোকানপাট ও শপিং মল। তাদের তুলনায় নিউ মার্কেটের বাইরের ও ভিতরের চেহারার জৌলুস কিছুটা কম ঠিকই, কয়েকটা দোকান ছাড়া বাজারের বাকি অংশ শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত নয় তাও ঠিক। কিন্তু আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে নিউ মার্কেটের আকর্ষণ অন্যান্য জায়গার বিলাসবহুল বিপণিগুলির চেয়ে কোন অংশে কম নয়, হয়তো বেশীই। একই ছাদের তলায় প্রায় আড়াই হাজার (সামান্য বেশিও হতে পারে) দোকানে পাওয়া যায় না এমন জিনিষ ভূ-ভারতে কোথাও নেই। আবার এমন দু’একটা জিনিষও আছে যা নিউ মার্কেট ছাড়া অন্য কোন বাজারে অমিল। যেমন ধরা যাক ব্যান্ডেল চীজ (Bandel Cheese) আর কালিম্পং চীজ (Kalimpong Cheese) নামে দুই ধরনের চীজ। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি হুগলি জেলায় অবস্থিত ব্যান্ডেল ছিল পর্তুগীজ উপনিবেশ। এখানেই লেবুর রসে জারানো গরুর দুধ থেকে তৈরী হতো সুস্বাদু চীজ যা সাহেবদের অতি প্রিয় ছিল এবং এটা বাজারে পরিচিত ছিল ব্যান্ডেল চীজ নামে। ঈষৎ লবণাক্ত স্বাদযুক্ত এই চীজ এখনও তৈরী হয়, তবে ব্যান্ডেলে আর নয়, বাঁকুড়া জেলার তারকেশ্বর আর বিষ্ণুপুরে, এবং পাওয়া যায় কেবল নিউ মার্কেটের তিন-চারটি দোকানে। এদের পাশেই রয়েছে সওয়াশ’ বছরেরও বেশি পুরনো, পুরুষানুক্রমে এক ইহুদী পরিবারের মালিকানাধীন আরেকটি দোকান, নাম নাহুম অ্যান্ড সানস্ (Nahoum & Sons), যা প্রথম খোলা হয়েছিল ১৯০২ সালে। আদতে এটা একটা বেকারী, অর্থাৎ পাঁউরুটি-কেক-বিস্কিট-নানা ধরনের পেস্ট্রী আর মাখন-চীজ বিক্রেতা। ক্রেতাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এই দোকান, কলকাতায় এমন লোকের সংখ্যা কম নয় যাদের মুখে নাহুমের তৈরী জিনিষ ছাড়া অন্য কিছু রোচে না। ব্যান্ডেল চীজের মতো কালিম্পং চীজও পাওয়া যায় কেবলমাত্র নিউ মার্কেটে। এই চীজ প্রথম তৈরী শুরু সিকিমের এক মনাস্টারী বা খৃষ্টান মঠের একজন যাজক ব্রাদার অ্যাব্রাহামের হাতে। তখন এটা বিক্রীর জন্য পাঠানো হতো দার্জিলিং জেলার কালিম্পং শহরে, তাই এই নাম। এখন অবশ্য কালিম্পং চীজ তৈরী হয় অন্যত্র এবং খুবই সীমিত পরিমাণে, দৈনিক বড় জোর দশ কিলোগ্রাম বা তারও কম, বিক্রী হয় নিউ মার্কেটের দু’তিনটি দোকানে। সালাদ জাতীয় খাবারকে আরো সুস্বাদু করে তোলায় এটার জুড়ি নেই। চীজ দেওয়া সালাদ যাদের পছন্দ তাদের অনেকে কালিম্পং চীজ ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতেই পারে না।
কলকাতার নিউ মার্কেট সত্যিই এক ‘সব পেয়েছির দেশ’।

ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199