আমার মুক্তি এই আকাশে

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 10 Feb 2022

2010 বার পড়া হয়েছে

Shoes

রুজভেল্ট দ্বীপে বসবাসের কালে প্রায়শ:ই আকাশের দিকে তাকাতাম। না তাকিয়ে উপায় ছিলো না। ছ’তলার আবাসনের বারান্দায় দাঁড়ালেই ম্যানহ্যাটনের বিস্তৃীর্ণ আকাশ দেখা যায়। আসলে আকাশের দিকে তাকানো আমার আজন্ম অভ্যেস। শৈশব ও কৈশোরে আকাশ দেখার যে খেলা শুরু হয়েছিলো, তা এখনও চলছে নিরন্তর। কত জায়গা থেকে আকাশ দেখি – বাড়ীর জানালা দিয়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে, বিমান থেকে। দপ্তরে কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে চোখ তুলে আকাশ দেখতাম। এখনও অবসরকালে সে অভ্যাস আমার  যায় নি।

পথ চলতে চলতে আকাশের দিকে দৃষ্টি যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াতাম, তখন কথা বলতে বলতে শ্রেনীকক্ষের জানালা দিয়ে চোখ তুলে চাইতাম আকাশের দিকে। মাঝে মাঝে মনে হতো, একটু নড়ে চড়ে বসে, খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে আকাশ হয়তো জিজ্ঞেস করছে, ‘ওহে, অত কি দেখছ’?

সারাদিন রাতে আকাশ কত রঙ বদলায়। প্রভাতের আকাশ বড় স্নিগ্ধ – ধূসর আঁধারের চাদর সরিয়ে ফিকে আলো আকাশ ছড়ায়। রৌদ্রতপ্ত মধ্যাহ্নে আকাশের দাপুটে ভাব অনুভব করা যায়। আবার সন্ধ্যায় আকাশ রঙ ধরে ‘নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা, সোনার আঁচল। খসার’। রাতে তারাদের ঝিকিমিকি সারা আকাশ জুড়ে।

বদলায় তো আকাশের সাজ আর মনও। কখনও কখনও ‘নীলাম্বরী শাড়ী পরে শ্রীমতী’ আকাশ শান্ত উদাস মনে বসে থাকে। অন্য কোন সময়ে ভারী খুশী মনে পেঁজা তুলোর ওড়না পরে আকাশ ভারী ঢং করে – ওড়নাটি একবার বাঁ থেকে ডানে, আরেকবার ডান থেকে বাঁয়ে জড়ায়। কখনো কখনো ‘আকাশটা বড় মেঘ কালো থাকে – জানালা খুলতেই মুখ ভ্যাংচায়’। ওই কালো মেঘের আকাশই হঠাৎ করে রোষে ফুঁসে ওঠে – তখন সে কি মেঘেদের দাপাদাপি, বিদ্যুতের ঘনঘটা। সেই রাগ পরিনত হয় অভিমানে – সজল অশ্রু নামে আকাশের বুক চিরে। তখন কেমন করে যেন মনে পড়ে যায় পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা ‘সেই গল্পটা’।

খুব ছোটবেলায় আকাশ দেখে ভয় পেতাম। হয়তো অত ছোট্ট একটি মানুষের চোখ আকাশের বিশালত্ব ধরতে পারত না ভয়ার্ত না হয়ে। মাঝে মাঝে মনে হতো আকাশটা একটা উল্টে দেয়া নীল বাটি – পৃথিবীটাকে ঢেকে দিয়েছে। ওটা ভাবতেই কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগতো। মাতামহীর বলা আকাশে অবস্হানরত ঈশ্বরের আমাদের সবার প্রতি সারাক্ষন চোখ রাখার গল্প কখনো স্বস্তিকর মনে হয় নি শিশু আমার কাছে। তাই তরফদার বাড়ীর চুরি করা আম আকাশের নীচে বসে খেতে পারি নি। স্কুল-ঘরের মধ্যে ঢুকতে হয়েছে এ বিশ্বাস নিয়ে যে আকাশে অবস্হানরত ঈশ্বরের চোখকে তা’হলে ফাঁকি দিতে পারবো।

কৈশোরে ঝড়ের আর বাদল ঝরা আকাশকে ভুলি কি করে? ‘মেঘের পরে মেঘ জমে যখন আঁধার হয়ে আসতো’ চারদিক, ঠান্ডা হাওয়া হইতো আর শুরু হতো কাল-বোশেখী, তখন ছুটে যাও আমবাগানে। শিলাবৃষ্টি হচ্ছে? ঠান্ডায় হি হি করতে করতে যত পারো মুখে পুরে দাও। তুমুল বর্ষার মধ্যে স্কুল থেকে ফেরার পথে বেছে নাও রাস্তার সেই দিকটা যেখানে ঝপাৎ করে জুতো ডোবাতে পারবে আর ছপাত ছপাত করে চলতে পারবে। বই ভিজে যাচ্ছে? অসুবিধে নেই। গায়ের জামা খুলে পুঁটুলি বানিয়ে তার মধ্যে বই ঢোকাও।

না, আকাশের সঙ্গে শুধু দুষ্টুমী করে পার পাওয়া যায় নি কৈশোরে। আকাশ উঠে এসেছে বইয়ের পাতায়। ‘আসলে তোমরা যে রকম ভাব, সে রকম আকাশ বলে কিছু নেই বাস্তবে’, বিজ্ঞান শিক্ষকের এ কথায় যে হোঁচট খেলেছিলাম, তা থেকে এখনও যে পুরোপুরি উঠে আসতে পেরেছি, তা বলা যাবে না। ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে’ – মুখস্ত করতে হয়েছে, সারাংশ আর সারমর্ম লিখতে হয়েছে, প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। শ্রীযুক্ত সুনির্মল বসু বড় একটা কম জ্বালাননি একটি কিশোর বালককে।

পরের দিনগুলোতে আকাশকে কতভাবে যে দেখেছি। মানুষকে সুখে-দু:খে আকাশের দিকে তাকাতে দেখেছি – কখনো ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে, কখনো অভিযোগ জানাতে, কখনো সুবিচারের আশায়। প্রিয়জন যাঁরা চলে গেছে তাঁদের কে ওতো মানুষ আকাশেই খোঁজে। তাই তো তারা ভরা রাতে সদ্য মাতৃহীন শিশুকন্যাটিকে কোলে নিয়ে আকাশের সবচেয়ে বড় তারাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আদ্র কণ্ঠে পিতা বলেন, ‘ঐ বড় তারাটিই তোমার মা’। তখন কি কন্যার জলভরা চোখের সঙ্গে পিতার অশ্রু মিশে যায় না?

মৌন পাহাড়ের পাশে আকাশকে দেখে মনে হয়েছে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। আকাশ আর সমুদ্র যেখানে মিশেছে, সেই দিগন্ত রেখার ওপারে কি আছে, সেটা যেন একটা রহস্যেরই ইঙ্গিত দেয়। কোথায় যেন শুনেছি , ‘আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিলাম’। ভালো লাগে ভাবতে। হাসি ও তো পেয়েছে যখন পড়েছি, ‘শুনেছ কি বলে গেল সীতেনাথ বন্দ্যো, আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ’?

তারপর কোন এক সময়ে আমাদের জীবনে হয়তো মেঘের পরে মেঘ জমে যায়, আঁধারও করে আসে – সর্ব অর্থেই। হয়তো আমরা বসেও থাকি একা দ্বারের পাশে। আমরা জানি না কোন সে দ্বার, কোন সে ঘর। এ পরবাসে পথ খুঁজে পাই না। কিন্তু কোন এক অমোঘ মুহূর্তে হৃদয়ের মাঝে শুনতে পাই, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে’।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199