ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ৩

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 11 Nov 2021

1760 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেও বেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

তিন.

আমার মামাবাড়ি ছিলো ‘নামতি’ (অর্থাৎ ‘নিম্ন) অসমের গোয়ালপাড়া জেলায় গৌরীপুর নামের ছোট শহরটিতে। মাইল পাঁচেক দূরের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত সদর শহরের নাম ধুবড়ি বা ‘ধুবুরি’। আকারে ছোট হলেও অন্য দু-একটি কারণে ঐ অঞ্চলে গৌরীপুর শহরের গুরুত্ব ছিলো যথেষ্ট। প্রথমত, গৌরীপুর ছিলো ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘রাজা’ খেতাবপ্রাপ্ত জমিদার প্রভাতচন্দ্র বরুয়ার পারিবারিক ভূসম্পত্তির মুখ্য জনপদ, এবং দ্বিতীয়ত, এই পরিবারের একাধিক সদস্য স্বনামধন্য ব্যক্তি। এঁদের একজন হলেন প্রভাতচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রমথেশচন্দ্র বরুয়া, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ভারতীয় সিনেমার ‘মুকুটহীন রাজকুমার’, কিংবদন্তীপ্রতিম প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা, যাঁর নাম আজও বাংলা (ও হিন্দি) চলচ্চিত্র প্রেমিকদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। আরেকজন হলেন প্রমথেশের কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রকৃতীশচন্দ্র বরুয়া, যিনি একজন বিশিষ্ট Elephantologist বা ‘হস্তিবিশারদ’ হিসাবে গোটা ভারতে, এমনকি ভারতের বাইরেও, প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। দেশবিদেশের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা প্রকৃতীশ সম্পর্কে বলতেন যে তিনি হলেন এমন একজন মানুষ যিনি হাতিদের সঙ্গে তাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাঁর পিলখানায় অনেকগুলি হাতি থাকতো, অসম ও উত্তরবঙ্গের নানা জঙ্গল থেকে ধরা, যাদের মধ্যে ছিলো সেই সময়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় আকারের হাতি যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘জঙ্গবাহাদুর’।

প্রমথেশ বড়ুয়া

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রমথেশের তৈরী ‘মুক্তি’ ছবিটির কুশীলবদের মধ্যে জঙ্গবাহাদুরও ছিলো একজন। এই চলচ্চিত্রটি মুক্তিলাভ করে ১৯৩৭ সালে। এর কয়েক বছর পরেই জঙ্গবাহাদুর মারা যায়। এশিয়ান হাতিদের গড় জীবনকাল মোটামুটি আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ-বাহান্নো বছরের মতো। সেই হিসাবে যে সময়ের কথা বলছি তখন জঙ্গবাহাদুর সম্ভবত প্রৌঢ়ত্বের শেষ প্রান্তে। সুতরাং তার মৃত্যু হয় পরিণত বয়সেই, স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত কারণে। ব্যতিক্রমও আছে, যেমন দাক্ষায়ণী নামে কেরল রাজ্যের একটি এশিয়ান হস্তিনীর খ্যাতি ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক হাতি হিসাবে এবং সে মারা যায় ২০১৯ সালে প্রায় ঊননব্বই বছর বয়সে। মৃত জঙ্গবাহাদুরের বিশাল দুটো দাঁতসহ তার প্রকা- মাথার খুলিটা শহরের কিছুটা বাইরে গদাধর নদীর তীরে একটা টিলার উপরে নির্মিত ‘মাটিয়াবাগ’ প্রাসাদের একটা ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো, ছেলেবেলায় অনেকবারই দেখে আমরা চমৎকৃত হয়েছি। সেটা এখনও সেখানে আছে কি না বা কোথায় আছে, জানিনা।

গৌরীপুর রাজপরিবারের তৃতীয় বিশিষ্টজন হলেন প্রমথেশের কন্যা প্রতিমা বরুয়া (পান্ডে), অসমের প্রখ্যাত ও অতীব জনপ্রিয় লোকগীতি শিল্পী। তাঁর গাওয়া মাহুত বন্ধু রে, হস্তির কন্যা, গদাধরের পারে পারে, বারো মাস তেরো ফুল ইত্যাদি গান এক সময়ে লোকের মুখে মুখে ফিরতো। চতুর্থজন, এবং আজও ইহলোকে বর্তমান, ব্যক্তিটি হলেন প্রকৃতীশচন্দ্রের কন্যা পার্বতী বরুয়া, যিনিও একজন অভিজ্ঞ হস্তিবিশারদ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ হিসাবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিত। গৌরীপুরের গুরুত্বের আরেকটি কারণ ছিলো সেখানকার ফুটবল খেলা। প্রমথেশ, প্রকৃতীশ দুজনেই ফুটবল ও ক্রিকেটে উৎসাহী ছিলেন এবং তাঁদের উদ্যোগে ও উদ্যমে একাধিক চমৎকার ফুটবল ও ক্রিকেট টীম তৈরী হয়েছিলো। ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রশস্তিসূচক একটা মজার ছড়া আমাদের ছোটবেলায় স্থানীয় লোকদের মুখে অনেকবার শুনেছি , কোচবিহারের রাস, বলরামপুরের বাঁশ / ছত্রশালের মেলা, আর গৌরীপুরের খেলা।

আমার বড় মামা নগেন্দ্রনাথ ও ছোট মামা সুরেন্দ্রনাথ দুজনেই গৌরীপুর রাজ-পরিবারের বড় ও ছোট রাজকুমার প্রমথেশ ও প্রকৃতীশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, বলা যায় একই সময়ে একই স্কুলে পড়াশোনা করে এবং এক সঙ্গে খেলাধুলা করে তাঁরা বড় হয়েছিলেন। তাঁদের এই ঘনিষ্ঠতা আজীবন স্থায়ী হয়েছিলো, যদিও অবশ্য প্রমথেশ চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ার পর থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়েছিলো। প্রমথেশ নিজেও গৌরীপুরে আসা বা থাকা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছিলেন কর্মব্যস্ততা ও অন্যান্য কারণে। প্রকৃতীশের সঙ্গে মামাদের বন্ধুত্বে কিন্তু ছেদ পড়েনি। এখানে বলে রাখি, প্রকৃতীশের ডাক নাম ছিলো ‘লালজী’। গৌরীপুরের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের কাছে তিনি ঐ নামেই পরিচিত ছিলেন, রাজবাড়ির কর্মচারী বা সাধারণ ‘প্রজা’দের মুখের সম্ভ্রমসূচক সম্বোধন ছিলো ‘লালজীবাবা’ কিংবা কেবল ‘বাবা’। ছোটবেলায় মামাবাড়িতে থাকার সময়ে আমি তাঁকে ‘লালজীমামা’ বলেই ডাকতাম। আমাকে তিনি খুবই ¯েœহ করতেন, নিজের মামাদেরই মতো।

লালজী মামাদের পারিবারিক বাসভবন স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিলো ‘রাজবাড়ি’ নামে। তার মূল ফটকের সামনে থেকে শুরু হওয়া বেশ লম্বা একটা লাল সুরকি বিছানো পথ বিস্তৃত ছিলো রাজবাড়ির প্রশস্ত চত্বরের প্রান্ত পর্যন্ত। রাস্তার দু-ধারে লম্বা লম্বা পাইন গাছের সারি। এক পাশে একটা বড় খোলা মাঠে পিলখানা যেখানে প্রায় সব সময়েই বেশ কয়েকটা হাতি বাঁধা থাকতো, তাদের মাহুতদের থাকার ঘরগুলিও ছিলো ঐ মাঠে। রাস্তার অন্য পাশে ছিলো একটা বিশাল দিঘি, লোকমুখে ‘রাজবাড়ির দিঘি’। আমার শৈশবের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ‘অকুস্থল’ হলো এই রাজবাড়ির দিঘি, সে প্রসঙ্গে পরে আসবো।
রাজবাড়ির এলাকার শেষ প্রান্তের বাইরে থেকে একটা মোটামুটি চওড়া পিচঢালা রাস্তা ধরে সোজা মাইল তিনেক দূরে গৌরীপুর রেলস্টেশন। যতদূর জানি, রাস্তাটা আজও আছে। আমার মামাবাড়ি ছিলো এই রাস্তার ধারে, রাজবাড়ি থেকে খুব দূরে নয়, বাড়ির সামনে থেকে দু’সারি পাইন গাছের মাঝের লালচে রঙের পথটা দেখাই যেতো। গৌরীপুরের বেশ কয়েকটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস ছিলো এই রাস্তার দু-ধারে। প্রমথেশ ও প্রকৃতীশের পিতা প্রভাতচন্দ্র বরুয়াকে সবাই সম্বোধন করতো ‘রাজাবাহাদুর’ বলে এবং তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলও খানিকটা এগিয়ে এই রাস্তার ধারেই। আমার স্কুলজীবনের সূচনাও এই বিদ্যালয়েই।
তাঁর পিলখানার সমস্ত হাতির মধ্যে লালজীমামার সবচেয়ে প্রিয় হাতির নাম ছিলো প্রতাপ।

প্রতাপের পিঠে চড়েই তিনি শিকারে যেতেন, অন্যান্য সব জায়গায় ঘোরাঘুরি করতেন। প্রতাপও যারপরনাই প্রভুভক্ত ছিলো। একবার শিকার করতে জঙ্গলে ঢুকে লালজী বাঘের হামলার মুখে পড়েছিলেন আর তখন প্রতাপ নাকি তেড়ে গিয়ে বাঘটাকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো। লালজীমামার অভ্যাস ছিলো প্রায় প্রতিদিনই হয় সকালে কিংবা বিকালে প্রতাপের পিঠে সওয়ার হয়ে রাজবাড়ির ফটক থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তা ধরে স্টেশনের মোড় পর্যন্ত গিয়ে আবার একই পথে ফিরে আসা। যাতায়াতের পথে মাঝে মাঝে থেমে পরিচিত লোকদের সঙ্গে আলাপ করতেন, পথচারী কোন ‘প্রজা’র সশ্রদ্ধ অভিবাদনের জবাব দিতেন। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে তিনি নিয়ম করে প্রতাপকে থামিয়ে আমার নাম ধরে হাঁক দিতেন। আমি বাড়িতে থাকলে বেরিয়ে আসতেই তিনি ডেকে বলতেন, ‘আয়, আয়, উঠে পড়।’ তাঁর ইশারায় প্রতাপ হাঁটু মুড়ে বসে পড়তো আর আমি কাছে এগিয়ে গেলেই ঐ দাঁতাল হাতি শুঁড় বাড়িয়ে আমার কোমর জড়িয়ে তুলে ধরে তার পিঠে বসিয়ে দিতো লালজীমামার কোলের কাছে।

প্রতাপ আমাকে বেশ চিনে গিয়েছিলো, আমাকে দেখলেই যেন তার কুতকুতে দুই চোখে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠতো, মাঝে মাঝে আদর করার ভঙ্গীতে আমার গায়েমাথায় শুঁড় বুলিয়েও দিতো। লালজীমামা বলতেন, হাতিরা নাকি ছোট ছেলেমেয়েদের খুব পছন্দ করে। রাজহস্তির পিঠে চড়ে বেড়িয়ে আমারও বেশ একটা রাজকীয় অনুভূতি হতো। সমবয়সী বন্ধুদের কিছুটা ঈর্ষা ও সমীহের পাত্রও ছিলাম বোধ হয় আমি।
গৌরীপুর রাজপরিবারের, বিশেষ করে লালজীমামা ও তাঁর হাতির সঙ্গে আমার শৈশবের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের স্বাদ নতুন করে আবার অনুভব করার একটা সুযোগ পেয়েছিলাম প্রায় পাঁচ দশক পরে, সুদূর বিদেশে বসে। সেটা ছিলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা অভিজ্ঞতা, যা সত্যিই আমাকে বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত করেছিলো যে ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’। এই আপ্তবাক্যটি যে কতটা যথার্থ তার প্রমাণ একটা বাস্তব ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো অচিরেই। (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199