ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ১০

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 3 Feb 2022

1765 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

দশ.

বিলেতে থাকার সময়ে ঊর্মি আর আমি দু-চার দিনের ছুটি পেলেই কোথাও না কোথাও বেড়াতে চলে যেতাম, সুযোগ হলে ইংল্যান্ডের বাইরেও। আমাদের একটি পছন্দের গন্তব্যস্থল ছিলো স্যুইট্জারল্যান্ডের জেনিভা শহর, যেখানে তখন আমাদের অতি প্রিয় ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা-ভগ্নীপ্রতিম অর্ণব আর লিসার নিবাস। তেমনই জুলাই মাসের এক শুক্রবার সন্ধ্যায় গ্যাটউইক্ বিমানবন্দর থেকে উড়ে জেনিভা পৌঁছেছি। সামনের সোমবার ইংল্যান্ডে ‘ব্যাংক হলিডে’ হওয়ায় ঊর্মির আর আমার জন্য এটা ‘লং উইকএন্ড’ বা দীর্ঘ সপ্তাহান্তের ছুটি। সুতরাং ওদের বাড়ি পৌঁছানোর পর লিভিং রূমে বসে স্বাভাবিকভাবেই আমরা চারজন আলোচনা করছিলাম সামনের দুটো দিন, শনিবার ও রবিবার, সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগানোর উপায় কী হতে পারে। আলোচনার মাঝে লিসা হঠাৎ বললো, ‘চলো না, আমরা রাইখেনবার্গ ফলস্-এ ঘুরে আসি?’

পাঠকদের মধ্যে যাঁরা রহস্য বা গোয়েন্দা কাহিনীর অনুরাগী, তাঁদের অনেকের কাছেই রাইখেনবার্গ ফলস্ হয়তো খুব একটা অপরিচিত নাম মনে হবে না। প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল-এর সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস্ ১৮৯০ সালে ‘আ স্টাডী ইন স্কারলেট্’ গল্পে প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে আজও পর্যন্ত ফিক্শন্যাল গোয়েন্দাদের মধ্যে সম্ভবতঃ এক নম্বর  এই রাইখেনবার্গ ফলস্-এই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও নাটকীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। শার্লক হোমস্কে নিয়ে কোনান ডয়েলের লেখা মোট ছাপ্পান্নটা ছোট গল্প এবং চারটা উপন্যাসের মধ্যে ‘দ্য ফাইন্যাল প্রবলেম’ গল্পটার অকুস্থল হলো এই রাইখেনবার্গ ফলস্, স্যুইট্জারল্যান্ড-অস্ট্রিয়া সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত একটি জলপ্রপাত।

লিসা, ঊর্মি, আমি তিনজনেই ক্ল্যাসিক ইংরেজি গোয়েন্দা কাহিনী লেখকদের রচনার একনিষ্ঠ ভক্ত, সুতরাং রাইখেনবার্গ ফলস্-এ বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাবে আমরা সোৎসাহে রাজি হয়ে গেলাম, অর্ণবও যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করলো। লিসা উঠে গিয়ে বইয়ের তাক থেকে ‘কমপ্লীট শার্লক হোমস্’ নামে সংকলনটা নিয়ে এলো। তার মধ্যে দেখি ‘দ্য ফাইন্যাল প্রবলেম’ গল্পটার সঙ্গে রাইখেনবার্গ ফলস্-এ যাওয়ার একটা ম্যাপও দেওয়া আছে, কাহিনী অনুযায়ী এই পথ অনুসরণ করেই শার্লক হোমস্ সেখানে গিয়েছিলেন। দেখেশুনে অর্ণব বললো যে ম্যাপে দেখানো পথঘাটের মধ্যে অনেকগুলোই বাস্তবে আছে এবং ঐসব পথ অনুসরণ করে সত্যিই হয়তো রাইখেনবার্গ ফলস্-এ যাওয়া যায়  ‘চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা কী? অন্ততঃ বেড়ানো তো হবে।’

অতএব পরদিন সকালে ব্রেক্ফাস্ট সারার পর আমরা চারজন গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়লাম রাইখেনবার্গ ফলস্-এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ষাট-সত্তর মাইল ড্রাইভ করার পর এক জায়গায় একটা সাইনপোস্ট দেখা গেলো যেটাতে জার্মান আর ইংরেজি ভাষায় রাইখেনবার্গ ফলস্-এর দিকনির্দেশ দেওয়া আছে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলাম যে ঐ জলপ্রপাত তো অবশ্যই আছে, তবে বইয়ের ম্যাপে দেখানো তার আশপাশের এলাকা নিশ্চয়ই তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বা সত্যি নয়, কারণ গল্পে যেসব বিবরণ দেওয়া আছে সেগুলো তো নিছকই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। যাই হোক, আরো কয়েক মাইল এগানোর পর হঠাৎ দেখি  পাঠকরা হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবেন না, আমরা নিজেরাই প্রথমটা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি , যেখানে আমরা এসে পৌঁছেছি সেই এলাকাটা, এক কথায় বলা যায়, যেন একটা বিশাল শার্লক হোমস্ ইন্ডাস্ট্রী!! সমস্ত রাস্তা, দোকানপাট, রেস্তোরাঁ , প্রায় সব কিছুই শার্লক হোমস্ নামাঙ্কিত। আমাদের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে শার্লক হোমস্ স্কোয়্যার, হোমস্ এভিনিউ, কোনান ডয়েল থিয়েটার, দ্য বেকার স্ট্রীট পাব . যার দরজায় নম্বর লেখা ‘২২১বি’ (২২১ই) , পাঠকরা নিশ্চয় জানেন লন্ডনে শার্লক হোমস্-এর বাড়ির ঠিকানা ছিলো , ছিলো বলছি কেন, এখনও আছে , ‘২২১বি বেকার স্ট্রীট’ , আজকের বেকার স্ট্রীট আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন আর লন্ডন প্ল্যনেটেরিয়াম-এর পাশে। সব মিলিয়ে বিস্মিত, অভিভূত হওয়ার মতোই পরিস্থিতি!

কিন্তু বিস্ময়ের বড় অংশটা এখনও বাকি। এখানকার প্রধান দর্শনীয় জায়গা অবশ্যই রাইখেনবার্গ জলপ্রপাত , যেখানে শার্লক হোমস্ এবং তাঁর সবচেয়ে পরাক্রান্ত শত্রু, আন্তর্জাতিক অপরাধ জগতের শিরোমণি ড. মরিয়ার্টীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিলো এবং মারামারি করতে করতে তাঁরা দুজনেই জলপ্রপাতের মাথা থেকে বহু নিচের খাদে পড়ে যান, যেমনটা ‘দ্য ফাইন্যাল প্রবলেম’ গল্পে বলা হয়েছে। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম পাহাড়ের নিচে থেকে তার মাথা পর্যন্ত , যেখানে একটা গহ্বর থেকে জলপ্রপাত নেমে আসছে , যাওয়ার জন্য কেবল্-কার রয়েছে এবং একটা জায়গায় পাহাড়ের পাথুরে গায়ে সাদা রঙ দিয়ে একটা বড় তারা আঁকা রয়েছে। আমাদের সঙ্গের অস্ট্রিয়ান গাইড ঐ তারাটা দেখিয়ে বললেন, ‘দেখো, ঐখানেই হোমস্ আর মরিয়ার্টীর মধ্যে মারামারি হয়েছিলো। ঐখান থেকেই তারা দুজনে নিচে পড়ে যায়।’ ভাবা যায়, সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটা কাহিনীকে বাস্তবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কী নাটকীয় প্রয়াস! শার্লক হোমস্ কাহিনীগুলোর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? তাছাড়া শার্লক হোমস্ ইংরেজি ভাষায় এবং প্রধানত ইংল্যান্ডেরই পটভূমিতে লেখা কল্পকাহিনীর একটা বিশুদ্ধ ব্রিটিশ চরিত্র, আর তার জনপ্রিয়তা ব্রিটেন থেকে সহস্ররাধিক মাইল দূরের অন্য দুই দেশের সীমান্তেও সমানভাবে প্রবল। কোনান ডয়েল-এর গল্পই রাইখেনবার্গ জলপ্রপাতকে এত বিখ্যাত করেছে।

আর্থার কোনান ডয়েল-এর মূল শার্লক হোমস্ কাহিনীগুলো ছাপা হতো লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘স্ট্র্যান্ড’ নামে একটি পত্রিকায়। সিড্নী প্যাজেট্ নামে একজন শিল্পী কাহিনীগুলোর ইলাস্ট্রেশন করতেন বা ছবি আঁকতেন। তাঁর আঁকা রাইখেনবার্গ জলপ্রপাতের মাথায় হোমস্ এবং মরিয়ার্টীর মারামারির ছবি এই লেখাটির সঙ্গে দ্রষ্টব্য।

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199