ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ১৫

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 24 Mar 2022

1810 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

পনেরো.

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বন্ধু সুব্রত লাহিড়ীর মাধ্যমে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও পরিচয়ের কথা আগে লিখেছি। ঐ সময়েই এক দিন, যতদূর মনে পড়ে সত্যজিতের বাড়িতেই, সুভাষ সিংহরায় নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। ভদ্রলোক একজন শিল্পী, অর্থাৎ চিত্রকর, শুনলাম ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিটির শিল্পনির্দেশনায় তিনি পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। প্রথম দর্শনেই তাঁর চেহারা আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিলো। কারণটা খুলে বলছি। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে ‘হুন্ডি’ আর ‘শুন্ডি’ এই দুই রাজ্যের রাজার দ্বৈত ভূমিকায় ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা সন্তোষ দত্ত সে’কথা পাঠকদের তো মনে আছে নিশ্চয়ই। তাঁর চেহারার সঙ্গে সুভাষ সিংহরায়ের চেহারার প্রায় হুবহু সাদৃশ্য, কেবল বয়স একটু কম। কিন্তু এক নজরে দেখলে দুজনকে যমজ ভাই-ই মনে হবে। শুনলাম ঐ ছবিটিতে তাঁকে ক্যামেরার সামনে ব্যবহার করাও হয়েছে সন্তোষ দত্তের ‘ডাবল্’ হিসেবে।

যাই হোক, সুভাষ সিংহরায়ের সঙ্গে আমার দারুণ জমে গেলো প্রথম আলাপ থেকেই, কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি হয়ে দাঁড়ালেন ‘সুভাষ-দা’ এবং আমাদের বেশ নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হতে লাগলো। কলকাতায় সেই সময়কার উদীয়মান শিল্পীদের মধ্যে দু-চারজন ছিলো আমার বন্ধুস্থানীয়, তারাও স্বাভাবিকভাবেই সুভাষ-দাকে চিনতো, সুতরাং তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠলো অচিরেই। এইভাবে দু-তিন মাস চলার পর একদিন সুভাষ-দা আমাকে টেলিফোন করে সন্ধ্যায় কলেজ স্ট্রীট কফি হাউজে আসতে বললেন, আমার সঙ্গে নাকি তাঁর কী সব জরুরী আলোচনা আছে। গেলাম কফি হাউজে, দো’তলায় কোনার দিকে একটা টেবিলে কফির কাপ সামনে নিয়ে গুছিয়ে বসলাম দু’জনে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলুন সুভাষ-দা, কী জন্য এই জরুরী তলব?’
সুভাষ-দা বললেন, ‘তোমার সাহায্য চাই একটা বিশেষ কাজের ব্যাপারে। আশা করছি তুমি একটু সময় দিতে পারবে।’
‘বলুন না, কী কাজ। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই সাহায্য করবো।’

‘সেটা বলার জন্যই ডেকেছি তোমাকে। আমি একটা ছোটখাটো প্রদর্শশালা, ঐ আর্ট গ্যালারী বলে যাকে, খোলার পরিকল্পনা করছি। জায়গাও ঠিক করে ফেলেছি, ভেতরটা সাজানোর কাজও শুরু হয়ে গেছে, সব রেডী হয়ে যাবে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে। সেই ব্যাপারেই , ‘আর্ট গ্যালারী?’ আমি খুশিদ হয়েই বললাম। ‘বাহ্, এ তো আনন্দের কথা! একাই করছেন সবটা?’
‘প্রজেক্টটা আমারই ব্রেইনচাইল্ড। আর্ট কলেজের দু’টি মেয়ে, আমার ছাত্রীই বলতে পারো, থাকছে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে। আর একটি অল্প বয়সী ছেলেও রয়েছে যেমন দরকার ফাইফরমাস খাটার জন্য।’
‘তা এই প্রজেক্টের জন্য আমার কথা ভাবছেন কেন? আমি তো আর্টের লাইনে নেই।’
‘আর্ট কলেজে যাতায়াত করেছিলে না কয়েক দিন?’

শিল্পী সুনীল দাসের আাঁকা ঘোড়া

‘হ্যাঁ, করেছিলাম বটে।’ সুভাষ-দা ঠিকই বলেছেন, গ্র্যাফিক আর্টস্-এর একটা দশ-বারো সপ্তাহের কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলাম একদা। তবে আমার শিল্পচর্চার মেয়াদ মোটামুটি ঐ পর্যন্তই, এর বেশি আর এগোয়নি বিশেষ। তাই জানতে চাইলাম, ‘আমার জন্য কী ভূমিকা ভেবেছেন?’
‘তেমন পরিশ্রমসাধ্য বা ঝামেলার কিছু নয়। যখন কোন শিল্পীর কাজের প্রদর্শনী হবে, আমি নিজে আর ঐ মেয়েরা সে’সব যেমন দরকার তেমনভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেবো। তোমাকে যে দায়িত্বটা নিতে হবে তা হলো গ্যালারীতে আসা দর্শকদের অভ্যর্থনা করা, এক্সিবিট্গুলোর দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, কেউ কোন ছবিটবি যদি কিনতে চায় সেই ব্যাপারে কথা বলা, দামটামের বিষয়ে আমি জানিয়ে দেবো তোমাকে আগেই, শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে নিয়ে। এক কথায় তুমি হবে গ্যালারী আর দর্শকদের মধ্যে কনট্যাক্ট। ঝামেলা মনে হচ্ছে?’
‘না, তা হচ্ছে না বটে। গ্যালারী খোলা থাকার সময় কী রকম হবে?’
‘ভেবেছি বেলা তিনটে থেকে রাত আটটা। গোড়াতে পাঁচ ঘন্টাই যথেষ্ট।’
‘সেটাতে একটু মুস্কিল হতে পারে। কলেজে আমাকে ক্লাস নিতে হয় সপ্তাহে চার দিন। বিকেল চারটের আগে তো ফ্রী হবো না। এক-আধ দিন পাঁচটাও হয়ে যেতে পারে। অন্য দু-তিন দিন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’
‘ঠিক আছে, তিনটে থেকে চারটে বা পাঁচটা মেয়েদের নিয়ে আমি সামলে নেবো। বেশিরভাগ দর্শক সন্ধ্যের দিকেই আসে, তাদেরও তো কাজকর্ম আছে। যেদিন পারবে সেদিন তাড়াতাড়ি চলে এসো। তবে একটা কথা , কোন প্রদর্শনী শুরু হওয়ার প্রথম দিনটা তোমাকে ম্যানেজ করতেই হবে যেভাবেই হোক। পারবে কি?’
‘চেষ্টা করবো। দিন বুঝে আর আগে থেকে জানতে পারলে।’
সুভাষ-দার সঙ্গে কথাবার্তা তো হলো। ওঁর প্রস্তাবে মোটামুটি রাজিও হলাম, যদিও কলেজের ক্লাসের দিনগুলোতে সময় কীভাবে ম্যানেজ করবো জানি না। তবে আমি নিজে খুব আগ্রহ বোধ করছিলাম সুভাষ-দার সঙ্গে থাকার ব্যাপারে। বেশ একটা উপভোগ্য অভিজ্ঞতা হবে নিঃসন্দেহে।

সে’সময়ের ড্যালহৌসী স্কোয়্যার, আজকের বি-বা-দী (বিনয়-বাদল-দীনেশ) বাগ এলাকায় সাকলাত প্লেস নামে একটা বহুতল বাড়ির পাঁচতলায় গ্যালারীর জন্য একটা বড় হলঘর ভাড়া নিয়েছিলেন সুভাষ-দা। হলের সঙ্গে সংলগ্ন আরেকটি ঘর, অনেকটা চারদিক ঢাকা লম্বা বারান্দার মতো, যেটাতে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এবং হলঘর লাগোয়া একটি টয়লেট্। ঐ বাড়ির মালিকপক্ষ এমন ডিজাইনের অ্যাপার্টমেন্ট কেন বানিয়েছিলেন জানি না, সম্ভবত কোন কনফারেন্স বা ঐ জাতীয় অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রেখে। সেখানে গিয়ে দেখলাম সুভাষ-দা এবং তাঁর সহায়করা খুব সুন্দরভাবে সব সাজিয়ে তুলছেন, কাজ প্রায় শেষের দিকে। হলঘরের চার দেওয়ালে ধবধবে সাদা রঙ করার, বিভিন্ন আকারের ছবি টাঙানোর, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, হালকা রঙের কয়েকটা ভারী পর্দাও ঝোলানো হয়েছে। সব মিলিয়ে যথেষ্ট রুচিসম্মত পরিবেশের প্রদর্শশালা গড়ে উঠছে। একটাই সমস্যা, ছবি দেখার জন্য দর্শকদের পাঁচতলা পর্যন্ত টানা কিছুটা মুস্কিল তো হবেই। সুভাষ-দা বললেন যে লিফট্ তো আছেই, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে না কাউকে, আর নামী শিল্পীদের কাজ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারলে দর্শক সমাগম নিশ্চয় হবে। একবার পরিচিতি পেয়ে গেলে পাঁচতলা কোন বাধা হবে না বলেই তাঁর ধারণা।
‘আরেকটা প্র্যাক্টিক্যাল বিষয় হলো,’ সুভাষ-দা বললেন, ‘যে ভাড়ায় জায়গাটা পাচ্ছি তাতে এই এলাকায় একতলায় কিছু পাওয়া অভাবনীয়। দেখা যাক না কিছু দিন, আমার দীর্ঘকালের স্বপ্ন এটা।’ মানতেই হবে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়।

প্রদর্শশালার নামকরণ করলেন সুভাষ-দা ‘গ্যালারী ইউনিক’। নামটা আমার বেশ পছন্দ হলো। সাজসজ্জার কাজ সম্পূর্ণ হলে বাংলা-ইংরেজি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার এবং প্রচারপত্র ছাপিয়ে একাডেমী অভ্ ফাইন আর্টস্ চত্বরে, সরকারী আর্ট কলেজে আর কয়েকটি বিদেশী কনস্যুলেট-এ বিতরণের ব্যবস্থা করলেন তিনি। এসব কাজে আমার নিজের প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা ছিলো না। ইতিমধ্যে সুভাষ-দা গ্যালারী উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললেন। এই প্রথম প্রদর্শনীতে নিজের কাজ উপস্থাপিত করায় সম্মত হলেন প্রবীণ শিল্পী সুনীলমাধব সেন। সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছিলেন সুভাষ-দা। আমার মনে পড়ে বাংলা ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরী, ইংরেজি ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র সুপরিচিত চলচ্চিত্র ও কলা সমালোচক নির্মল কুমার ঘোষ (এন.কে.জি) এবং ‘দ্য স্টেটস্ম্যান’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক সুনন্দ কে. দত্তরায়কে আমন্ত্রণ জানাতে যাওয়ার সময়ে সুভাষ-দার অনুরোধে আমি তাঁর সঙ্গী হয়েছিলাম। এঁরা ছাড়াও আরো কয়েকজন সাংবাদিক-প্রতিবেদক এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পরিচিত কয়েকজনকেও উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিলো।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জকই হয়েছিলো। শিল্পী সুনীলমাধব তো উপস্থিত ছিলেনই, আমন্ত্রিত সাংবাদিকরাসহ অন্যান্য অভ্যাগতরাও সবাই এসেছিলেন। বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন শিল্পানুরাগী সাধারণ দর্শকও, যাঁরা কোনওভাবে আমাদের গ্যালারীর কথা জানতে পেরেছিলেন, এসেছিলেন, হয়তো কৌতূহলবশতই। তবে সব মিলিয়ে আমরা বেশ উৎসাহবোধ করছিলাম। সুভাষ-দার দীর্ঘদিন লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ায় তাঁকে যথেষ্টই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো। সুনীলমাধবের কাজ তো শিল্পরসিক মাত্রের কাছে সমাদৃত, সুতরাং প্রদর্শিত ছবিগুলো নিশ্চয়ই আগন্তুকদের সকলেরই ভালো লেগেছিলো। ছবি কেনার কোন প্রস্তাব অবশ্য সেদিন আসেনি। দু-চার দিনের মধ্যেই বাংলা ও ইংরেজি কাগজগুলোতে গ্যালারী ইউনিক-এর প্রথম শিল্পকলা প্রদর্শনীর খবর ছাপা হলো। প্রতিবেদকরা সকলেই প্রদর্শশালার প্রশংসা করেছিলেন। একটি প্রতিবেদনে যেমন লেখা হয়েছিলো: “এমন একটি মনোরম পরিবেশে ছবি দেখার তৃপ্তির তুলনায় পাঁচতলায় চড়া দর্শকের কাছে আয়াসসাধ্য মনে হবে না।” এর পর থেকে প্রতিদিনই একটি-দুটি ছবি বিক্রী হওয়া শুরু হয়েছিলো। সুনীলমাধবের কাজ ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখায় আগ্রহী লোকজনের সংখ্যা ও তাদের দাম সে সময়ের শিল্পকলার বাজারে ভালোই ছিলো। একটি কাজ যেমন ছিলো ঠিক রঙ-তুলি দিয়ে আঁকা ছবি নয়, বোর্ডের ওপরে গালা দিয়ে তৈরী করা বা আঁকা একটা ষাঁড়ের মাথা। কত দাম ছিলো ঠিক মনে নেই তবে কম কিছু নয়, কিন্তু এক ভদ্রলোকর সেটা দেখে এতই পছন্দ হয়ে গেলো যে তিনি দ্বিরুক্তি না করে সেটা কিনে ফেললেন। আরেকটি কাজ ছিলো একই মাধ্যমে তৈরী গণেশের প্রতিকৃতি, সেটাও বেশ চড়া দামেই বিক্রী হয়েছিলো। অ্যামেরিকান কনস্যুলেট-এর একজন কর্মকর্তা স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন প্রদর্শনী দেখতে। মহিলা কিনেছিলেন সাদা কার্ট্রিজ পেপারের ওপরে কালো রঙে আঁকা আলিঙ্গনবদ্ধ এক জোড়া যুবক-যুবতীর ছবি। সুনীলমাধবের এই প্রদর্শনীর মেয়াদ ছিলো তিন সপ্তাহ। বিক্রীত শিল্পকর্মের দামের একটা শতাংশ গ্যালারীর প্রাপ্য কমিশন হিসেবে। সেই সূত্রে এই প্রদর্শনী থেকে সুভাষ-দার প্রাপ্তি খুব খারাপ হয়নি।

এর দু’সপ্তাহ পর দ্বিতীয় প্রদর্শনী। এবারের শিল্পী সুনীল দাস, যাঁর আঁকা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ঘোড়ার ছবি, রঙিন ও সাদা-কালো দুইই, শিল্পরসিকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো। সুনীল দাস তখন প্রবীণ শিল্পী নন, ঐ সময়ে তাঁর বয়স চল্লিশের বেশি নয়, তবে যথেষ্টই নামডাক হয়েছে। তাঁর প্রদর্শনী চলেছিলো চার সপ্তাহ এবং তাঁর ছবিও বিক্রী হয়েছিলো বেশ কয়েকটা। সুনীল দাসের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের কোন সুযোগ এর পরে হয়নি আমি বিলেতে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। পরবর্তী তিন দশকের মধ্যে একবার আমি কলকাতায় এলে কোন একটা উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হয়। তখন তিনি খুবই অসুস্থ, চলাফেরা বিশেষ করতে পারেন না, আঁকাজোকাও বন্ধই। তবে গ্যালারী ইউনিক-এ তাঁর কাজের প্রদর্শনীর কথা উল্লেখ করায় তিনি বললেন যে তাঁর মনে আছে সেটা, আমাকেও মনে করতে পারলেন ভাসা ভাসা। এর কিছু দিন পরেই তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম।

এর পর দীর্ঘদিন, তা প্রায় মাস তিনেক তো হবেই, গ্যালারী ইউনিক-এ কোন প্রদর্শনীর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি বিভিন্ন কারণে। কলকাতার সমসাময়িক শিল্পীরা এই প্রদর্শশালার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। উদীয়মান শিল্পীরা, যেমন গণেশ পাইন, ধর্মনারায়ণ, বিকাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ, নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছিলেন কিন্তু প্রদর্শনীর ব্যাপারে তাঁদের কেমন একটা অনীহা ছিলো। তারপর ওড়িশার একজন শিল্পী, নাম প্রফুল্ল মহান্তি, যিনি বাংলার দর্শকদের সামনে তাঁর কাজের নমুনা পেশ করায় আগ্রহী ছিলেন, গ্যালারী ইউনিক-এ প্রদর্শনী করতে রাজি হলেন। ইনি প্রধানত ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ বা বিমূর্ত ধরনের কাজ করতেন। ওড়িশায় তিনি যথেষ্ট পরিচিত শিল্পী ছিলেন, যদিও বাংলা তথা কলকাতায় ততটা নয়। তাঁর কাজ দেখতে প্রদর্শশালায় দর্শক সমাগম মন্দ হয়নি তবে ছবির বিক্রী কিছুটা নৈরাশ্যজনকই ছিলো।

প্রফুল্ল মহান্তি প্রসঙ্গে একটা আশ্চর্য কাকতালীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিলো আমার প্রায় বছর পনেরো পরে, লন্ডনে। এক গ্রীষ্মের অপরাহ্নে ঊর্মি আর আমি সাউথব্যাংকে টেমস্-এর ধারে হাঁটছি। পাশে সারি দিয়ে রয়্যাল ফেস্টিভ্যাল হল, ক্যুইন এলিজাবেথ হল, ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটার, লন্ডন অ্যাকোয়ারিয়াম ইত্যাদি। এদের মধ্যে প্রথম দু’টিতে শিল্পকর্মের প্রদর্শনী আয়োজিত হয় মাঝেমধ্যে। ক্যুইন এলিজাবেথ হলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ চোখে পড়লো তার প্রবেশপথের ধারে স্ট্যান্ডে বসানো একটা বিজ্ঞপ্তি - ‘এক্সিবিশন অভ্ পেইন্টিংস্ বাই ইন্ডিয়ান আর্টিস্ট’। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে, দেখি বিজ্ঞপ্তিতে লেখা শিল্পীর নাম , ‘প্রফুল্ল মহান্তি’! আমি তো যারপরনাই অবাক। দরজা পেরিয়ে প্রদর্শশালার ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম এক ধারে একটা টেবিলের ওপারে সত্যিই একজন পরিচিত মুখের মানুষ। গত দেড় দশকে চেহারার কিছুটা পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু চেনা যায় না এমনটা নয়। এত বছর পরে এভাবে সুদূর বিদেশে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবা যায়! সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তিনি মুখ তুলে চাইলেন, চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, ভারতীয় চেহারার লোক দেখে সামান্য স্মিত হাসিও। ইংরেজিতে বললাম, ‘আমাকে নিশ্চয় মনে নেই আপনার। প্রায় পনেরো-ষোলো বছর আগে কলকাতায় আপনার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিলো, প্রদর্শশালার সঙ্গে জড়িত লোকদের মধ্যে আমিও ছিলাম।’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রফুল্ল মহান্তির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, তিনিও ইংরেজিতেই উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। চিনেছিও আপনাকে, চেহারা বিশেষ পালটায়নি। কলকাতায় প্রদর্শনীর সময়ে আমার মা এসেছিলেন আমার সঙ্গে। এক সন্ধ্যায় আপনি গাড়ি নিয়ে গিয়ে মা-কে হোটেল থেকে গ্যালারীতে নিয়ে এসেছিলেন। কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি,’ বললাম আমি। ঊর্মির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। হাসিমুখে নমস্কার জানিয়ে প্রফুল্ল বললেন, ‘আপনাদের দেখে খুব ভালো লাগছে, বিলেতেই থাকেন এখন?’
‘হ্যাঁ। আপনি?’
‘আমি দেশেই আছি। তবে এদেশেও আসি-যাই। গত কয়েক বছরে চার-পাঁচবার হয়ে গেলো। ক্যুইন এলিজাবেথ হলেই আমার প্রদর্শনী হলো এই নিয়ে দু’বার। অন্যত্রও হয়েছে।’
তার মানে শেষবার কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে শিল্পী হিসেবে প্রফুল্ল মহান্তির নামডাক দেশে-বিদেশে বেশ ছড়িয়েছে। ক্যুইন এলিজাবেথ হলের মতো অভিজাত প্রদর্শশালায় একাধিকবার প্রদর্শনীই তার প্রমাণ। খুবই ভালো লাগলো কথাটা শুনে। আরো কয়েক মিনিটের আলাপচারিতার পর ঊর্মি আর আমি বিদায় নিলাম সর্বান্তকরণে প্রফুল্ল মহান্তিকে আমাদের শুভকামনা জানিয়ে।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, গ্যালারী ইউনিক-এর আয়ুষ্কাল দীর্ঘায়িত হলো না। বছর দুয়েক পেরুনোর আগেই প্রদর্শশালাটির দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। তার কারণ দু’টি - প্রথমত, কলকাতার (এবং অন্যান্য জায়গারও) শিল্পীদের আশানুরূপভাবে অনুপ্রাণিত করা গেলো না এখানে তাঁদের কাজের প্রদর্শনী করায়। দ্বিতীয়ত, শিল্পীদের অনাগ্রহের দরুণ সুভাষ সিংহরায়ও উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন ক্রমে এবং অন্য দিকে মনোনিবেশ করতে লাগলেন উত্তরোত্তর বেশি করে। তাছাড়া গ্যালারী চালু রাখার ব্যয় সংকুলান করাতেও তাঁর বেশ সমস্যা হচ্ছিলো। শেষমেষ তিনি ঝাঁপ বন্ধ করারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। আমাকে বলেছিলেনও তিনি, ‘জমানো পুঁজি শেষ হয়ে আসছে, বুঝলে। আর টানতে পারছি না।’ কথাটা শুনে খারাপ লেগেছিলো অবশ্যই, কিন্তু রূঢ় বাস্তবেেক তো মানতেই হবে। সুভাষ-দার নিজের কথাতেই , ‘অনেক দিনের স্বপ্ন ছিলো একটা, পূরণের চেষ্টা করলাম যথাসাধ্য। পুরোপুরি না হলেও খানিকটা তো পূরণ হলো। তাই বা মন্দ কী?’

ছবিঃ গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199