ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ১৪

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 17 Mar 2022

1970 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

চোদ্দ.

উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর সামনের বড় রাস্তা পেরিয়েই উলটো দিকের গলির ভেতরে একটা ভাড়াবাড়ির তিনতলায় একটা দু-কামরার ফ্ল্যাটে ছিলো আমার নিবাস। এই ফ্ল্যাটের উল্লেখ আমি আগেও করেছি। আশি’র দশকের মাঝামাঝি বিলেতে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর এই ফ্ল্যাটেই আমি কাটিয়েছি মোটামুটি আরামেই। থাকতাম একাই, সকালের চা বা কফি নিজেই তৈরি করে নিতাম, আজও যেমন করি। এছাড়া যৎসামান্য রান্না, ঘরদোর ঝাড়পোঁছ এবং অন্যান্য টুকিটাকি কাজ করে দিতেন ঐ পাড়ারই বাসিন্দা একজন প্রবীণ মহিলা। রোজ সকাল সকাল আসতেন, ঝট্পট্ সব কাজ সেরে ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই চলে যেতেন। তাঁর নাম কী ছিলো জানি না, কেউই সম্ভবত জানতো না, পাড়ার সবাইয়ের এবং আমারও কাছে তাঁর পরিচয় ছিলো ‘বীণার মা’ নামে। আবার এই ‘বীণা’ যে কে সেটাও কেউ জানতো না, যদিও মহিলার একটি নাতনি ছিলো যে ঐ অজানা “বীণার” মেয়ে বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।

আমি ঐ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হওয়ার বছর দেড়-দুই বাদে পাশের ফ্ল্যাটের পুরনো ভাড়াটেরা উঠে গেলেন। কিছু দিন পর নতুন ভাড়াটে হয়ে এলো চারজনের একটি পরিবার, এক প্রবীণ দম্পতি এবং তাঁদের পুত্র ও পুত্রবধু। এঁদের সঙ্গে অল্পদিনের মধ্যেই আমার বেশ হৃদ্যতা জন্মে গেলো। ঐ পরিবারের কর্তা বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি আমার প্রতি যথেষ্ট ¯েœহপ্রবণ ছিলেন, আমি বাড়ি থাকলে প্রায়ই এসে গল্পগুজব করতেন। এক সময়ে তিনি একটি নামকরা বাংলা সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর সাংবাদিক জীবনের নানারকম অভিজ্ঞতার বিবরণ আমি আগ্রহ নিয়েই শুনতাম। প্রায় ছয়-সাত বছর আমরা পাশাপাশি বাস করেছি তিনতলার ঐ দুই ফ্ল্যাটে।

আমার নিকটতম প্রতিবেশী এই বৃদ্ধের একটা প্রিয় অভ্যাস ছিলো প্রায় প্রত্যেক দিন সকালে নিজের হাতে বাজার করা। বাজার বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়, যাওয়ার সময় হেঁটেই যেতেন, ফিরতেন বাজারের থলি নিয়ে টানা রিক্শায় চড়ে। তাঁর একটা পায়ে কোনরকম সমস্যা ছিলোু, যে জন্য ঐ পা-টা টেনে টেনে হাঁটতেন, জুতোয় খস্-খস্ করে একটা ঘস্টানোর মতো আওয়াজ হতো। পায়ের সমস্যার জন্যই লাঠি নিয়ে চলতেন, তাই হাঁটার সময় রাস্তায় পা টানার খস্-খস্ আওয়াজের সঙ্গে লাঠি ঠোকার ঠক্-ঠক্ শব্দ পাশাপাশি শোনা যেতো। বাড়ির একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত সিঁড়িতেও ঐ ‘খস্-খস্’ আর ‘ঠক্-ঠক্’ আওয়াজ কানে এলেই বোঝা যেতো উনি সিঁড়ি ভেঙে নামছেন বা উঠছেন। সিঁড়ির মাথায় আমার ফ্ল্যাটের দরজার পাশেই ওঁদের ফ্ল্যাটের দরজা। অনেক সময়েই নিজেদের দরজার কড়া নাড়ার আগে ভদ্রলোক তাঁর লাঠি ধরা হাতটা আমার দরজার গায়ে রেখে টাল সামলাতেন, ‘খট্’ করে একটা শব্দ হতো, তারপরই পাশের দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেতাম।

বাজার সেরে ফেরার পর ভদ্রলোকের আরেকটা অভ্যাস ছিলো শোবার ঘর-সংলগ্ন ছোট ব্যালকোনীর সামনে পাতা একটা ডেক্-চেয়ারে বসে আয়েস করে এক কাপ চা খেতে খেতে সেদিনের খবরের কাগজে চোখ বোলানো, সেই সঙ্গে সিগারেটে সুখটান দেওয়া। হ্যাঁ, সিগারেট উনি খেতেন প্রচুর, ঐ বয়সেও, প্রায় সব সময়েই হাতের দুই আঙুলেরফাঁকে গোঁজা থাকতো জ্বলন্ত সিগারেট। এক দিন যথারীতি বাজার থেকে ফিরেছেন, সিঁড়িতে পরিচিত ‘খস্-খস্’ আর ‘ঠক্-ঠক্’ আওয়াজ শুনে আমিও বুঝতে পেরেছি যে উনি ফিরলেন। এর কিছুক্ষণ পরে আমি ¯œান সেরে জামাকাপড় পরে কাজে বেরোনোর জন্য তৈরী হচ্ছি, এমন সময় আমার দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দেখি পাশের ফ্ল্যাটের বয়স্কা কাজের মহিলা অত্যন্ত বিচলিত মুখে দাঁড়িয়ে
‘দাদাবাবু, শীগ্গির একবার আসবেন? বাবা যেন কেমন করছেন!

তাড়াতাড়ি মহিলার সঙ্গে পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম বৃদ্ধ তাঁর ডেক্-চেয়ারের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছেন, চোখ বিস্ফারিত, দৃষ্টিহীন, দুই হাত চেয়ারের দুই পাশে লট্পট্ করছে। মেঝের ওপর গড়াচ্ছে ওলটানো চায়ের কাপ, তার কাছেই আধপোড়া সিগারেটের টুকরো। এখনও বেঁচেই আছেন বোধহয়, কারণ ঠোঁট দু’টো অল্প অল্প কাঁপছে মনে হলো। সামনে হতভম্বভাবে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধের স্ত্রী ও পুত্রবধু। কাজের মহিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের দাদাবাবু কোথায়?’
‘দাদাবাবু তো সেই কখন বেরিয়ে গেছে, বাবা বাজার থেকে ফেরার আগেই,’ মহিলা বললেন।
‘তাড়াতাড়ি একটা মাদুর-টাদুর পাতো মেঝেতে, ওঁকে চেয়ার থেকে নামিয়ে শোয়াতে হবে।’

অচেতন বৃদ্ধকে দু’জনে মিলে ধরে নিচে শুইয়ে দিলাম। মহিলাকে বললাম, ‘একটু জল আনো, মুখে দিয়ে দেখি।’ সে জল নিয়ে আসতে সাবধানে বৃদ্ধের মুখে ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, দু-এক ফোঁটা মুখে গেলো হয়তো, বাকিটা কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলো। ইতিমধ্যে বাড়ির অন্যান্য তলার বাসিন্দাদের কয়েকজন এসে গেছেন। তাঁদের একজন মেঝের ওপর শায়িত বৃদ্ধের দিকে অভিজ্ঞ চোখে এক নজর তাকিয়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে মৃদু স্বরে বললেন, ‘এ তো মনে হচ্ছে হয়ে এসেছে। দাঁড়ান, ডাক্তারকে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’

পাড়ার ডাক্তারবাবু এসেও গেলেন মিনিট কুড়ির মধ্যেই, রূটিনমাফিক বৃদ্ধের নাড়ি টিপলেন, বুকে স্টেথোস্কোপ বসালেন, তারপর হাত দিয়ে বিস্ফারিত চোখদুটো বন্ধ করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চেম্বারে আসুন কেউ একজন, ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছি।’ আমিই গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে, সার্টিফিকেট নিয়ে ফিরে এসে সেটা সদ্যমৃতের ছেলের বউএর হাতে দিলাম। শুনলাম ছেলেকে আর কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধুকে খবর দেওয়া হয়েছে, সবাই এসে যাবেন অবিলম্বে। আমার আর করণীয় কিছু ছিলো না, তাই আমি নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে টের পেলাম যে পাশের ফ্ল্যাটে লোকজনের আসা শুরু হয়েছে, আমি আর সেদিকে না গিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে গেলাম। এর পরের কয়েক দিনে শ্রাদ্ধশান্তি আর অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম যথারীতি হয়ে গেলো, তাদের মধ্যে আমার নিজের কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো না।

মাস তিনেক পরের কথা। মার্চের শেষের দিক, গরম পড়তে শুরু করেছে, ফ্যান চালালে আরামই লাগে। আমার আবার গরম বোধটা একটু বেশী, তাই রাস্তার দিকের জানালা ছাড়া ব্যালকনীতে যাওয়ার দরজাটাও খোলা রাখি রাতে ঘুমানোর সময়। ওদিকটা দক্ষিণ, সুন্দর বাতাস আসে। এক রাতে ঘুমিয়ে আছি বেশ আরামেই, হঠাৎ যেন ঘুমের মধ্যেই কানে এলো সেই পরিচিত শব্দ খস্-খস্ . . . ঠক্-ঠক্ খস্-খস্ . . . ঠক্-ঠক্ পায়ে পায়ে শব্দটা উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে একতলা থেকে তিনতলায়। ঘুম ভেঙে গেলো, কিন্তু প্রথমটা ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না এখন দিন না রাত, আচমকা জেগে উঠলে ঘুমের ঘোর না ভাঙা পর্যন্ত যেমনটা হয়। কয়েক সেকেন্ড পরই সিঁড়িতে পা ঘষার আর লাঠি ঠোকার শব্দ ঠিক আমার দরজার বাইরে এসে থেমে গেলো, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় ধাক্কার পাশাপাশি ‘খট্’ করে একটা কেঠো শব্দ। কিছু না ভেবেই আমি বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে সেটা খুলে দিলাম। সামনেই দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, অতি পরিচিত ভঙ্গীতে তাঁর লাঠিধরা হাতটা দরজার গায়ে রেখে যেন টাল সামলাচ্ছেন। রাস্তার দিকের জানালা আর দরজা দিয়ে আসা জ্যোৎ¯œার আলোয় আমি তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, চশমার গোল কাঁচের পেছনে তাঁর চোখদুটো সোজা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, একটু হাঁপাচ্ছেন যেন। সামান্য ঘড়ঘড়ে গলায় তিনি বললেন, ‘বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল খাওয়াবে?’

আমার খাটের পাশে রাখা একটা ছোট্ট মাটির কুঁজোয় জল থাকে। আমি পেছন ফিরে কুঁজো থেকে গ্লাসে জল ঢেলে সেটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। কিন্তু এ কী! সামনের খোলা দরজার বাইরে তো কেউই নেই! কোথায় গেলেন উনি? ঠিক সেই মুহূর্তে, মাথার ভেতরে আকস্মিক বিদ্যুতের শিহরণের মতো, আমার মনে পড়ে গেল ঐ বৃদ্ধ তো বেঁচে নেই, মারা গেছেন তিন মাস আগেই! তাহলে আমি কী দেখলাম? এখনও, এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি যেন একটা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম অবিশ্বাসী চোখে, হাতে ধরা জলভরা গ্লাস, পা-দুটো যেন আঠা দিয়ে মেঝের সঙ্গে সাঁটা, নাড়াতে পারছি না। তারপর, কতক্ষণ পর জানি না, বাড়ির নিচের রাস্তা দিয়ে বিকট ঘড়াং-ঘড়াং আওয়াজ করে একটা ট্রাক-জাতীয় কোন গাড়ি চলে গেল আর সেই আওয়াজেই বোধহয় আমার ঘোর কেটে গেলোু। খুব আস্তে আস্তে পেছন ফিরে, হাতের জলভরা গ্লাসটা সন্তর্পণে কুঁজোর পাশে নামিয়ে রাখলাম, তারপর খাটের ওপরে বসে পড়ে সিঁড়ির মুখে খোলা দরজার দিকে চেয়ে রইলাম স্তম্ভিতভাবে বেশ কয়েক মিনিট ধরে। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছিলো, দক্ষিণের জানালা আর দরজা দিয়ে বাতাসও আসছিলো, অথচ আমি বুঝতে পারছিলাম আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে উঠছে।

কী দেখেছিলাম সেই রাতে জানি না, কোন ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টাও কখনো করিনি। শুধু এইটুকু জানি যে বৃদ্ধের প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে আমার হাতই তাঁর মুখে কয়েক ফোঁটা জল ঢেলে দিয়েছিলো।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199