অন্তরালে অসাধারণ রাশিদ খান…

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 11 Jan 2024

1920 বার পড়া হয়েছে

Shoes

পৃথিবী থেকে আরেকবার সুর আর গান বিদায় নিলো। প্রয়াত হলেন অসাধারণ এক সঙ্গীতশিল্পী রাশিদ খান। হয়তো সুরের, গানের দুনিয়ায় শূন্যস্থান হয় না। থাকেও না। কিন্তু রাশিদ খান সুরের যে মোহজাল বিস্তার করেছিলেন, গানের মধ্যে যে নিবেদনের ঘ্রাণ উপহার দিয়েছিলেন সেটুকুর অনুপস্থিতি সঙ্গীতপিপাসু মানুষ মনে রাখবেন। সুর আর গানের বিদায় বলে কিছু নেই আসলে। রাশিদ খানও বিদায় নেননি। দূরের নক্ষত্র হয়ে থেকে গেলেন হৃদয়ে।

তাঁর মৃত্যুতে মিউজিশিয়ান দেবজ্যোতি মিশ্র আর কবি শ্রীজাত বন্দ্যেপাধ্যায়  শোক এবং প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেখান থেকে লেখাদু’টো প্রাণের বাংলার পাঠকদের জন্য এখানে দেয়া হলো হলো।

দেবজ্যোতি মিশ্র (মিউজিশিয়ান)

তুই চললি কোথায়? ভরা ম্যাহফিলে ঝরা পাতার উশকোখুশকো হাততালির গমকে ঝাড় লন্ঠনটা কাঁপছে। আমরা সবাই বসে আছি রে রাশিদ! একটা আস্ত ঘর কফন হয়ে বসে আছে। একটা সুরের দেশ একটা আস্ত যৌবন একটা রাত একটা অভিসার বসে আছে রাশিদ! মাইক্রোফোনে শনশন করে সমুদ্রের শব্দ বেজে যাচ্ছে-- তোর উত্তরপ্রদেশের শীতকালে যখন রেওয়াজে বসতিস, তখন শীত করত না তোর? সমুদ্রে এত শীত-- চারদিকে এত জল আমাদের শিরা উপশিরায় নুন ঢুকে যাচ্ছে! দোহাই দোস্ত! মাঝেমাঝে ঢেউগুলো এক একজন রাশিদ খাঁ হয়ে উঠলেও দোষ নেই, কিন্তু রাশিদ তুই সমুদ্ররূপ ধরলে কে আর কাঁধে হাত রাখবে? যেমন আমরা হেঁটে যেতাম-- তুই আমার কাঁধে রাখতিস আর সকাল থেকে বয়ে আনা ফুলের গোছারা ঝম করে ঝরে যেত! তোর ওই জোর ছিল। তোর গলার ওই স্পন্দন ছিল! বালি বালি উড়ে যাচ্ছে বালির ভাস্কর্য। নিজেই বাঁধছিস নিজেই ভাঙছিস নিজেই রাখছিস নিজেই ডুবছিস, কখনও নিজেই ভাস্কর্য হয়ে উঠছিস আর তোর হাতের অনুভবগুলো গলায় গিয়ে ঢুকছে-- গলার আদরে কীসব শৃঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে খাজুরাহো-- তোর যমুনার জল, তোর সুখ! আদিম একটা-- আর পারছি না রে... তোকে আর সহ্য করতে পারছি না-- তুই মাইক্রোফোনে, কিংবা মাইক্রোফোন ছাড়াই এই ম্যাহফিলে ফিরে আয়। খুব শীত করছে। বড় বিপন্ন বোধ হচ্ছে।

শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় (কবি)

আপাতত এই ছবিটাই থাক। এমন নয় যে এ-ছবি এই প্রথমবার ভাগ করে নিচ্ছি, কিন্তু আবারও যে রাখছি, তার আড়ালে একখানা মিথ্যে লুকিয়ে আছে। সেইটে বলবার জন্যই ছবিটা রাখা আরও একবার। এই কয়েক বছরে আমার আর দূর্বা’র সঙ্গে রাশিদদা’র অজস্র স্মৃতি তৈরি হয়েছে এক এক ক’রে, সেসব আস্তে আস্তে লিখব। মঞ্চের এক অদ্বিতীয় শিল্পী থেকে একজন দিলখোলা ঘরোয়া মানুষকে কীভাবে খুঁজে পেয়েছি, সে-কাহিনি এক-লেখায় শেষ হবার নয়। তাই রাশিদদাকে নিয়ে আরও লিখব, বহুবার লিখব। এমনটাই ইচ্ছে। তবু যে এই লেখাকেই প্রথমে নিয়ে এলাম, তার কারণ ওই একটাই। মিথ্যেটা আগে স্বীকার করে নেওয়া ভাল।

বছর দুয়েক আগের শেষ-বসন্তের এক সন্ধেবেলা রাশিদদা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গীত আকাদেমি প্রচলিত এই সম্মাননা, ‘শ্রীনন্দিনী’ পুরস্কার। মঞ্চে অনেকক্ষণ দু’জনে পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, বহুদিনের জমা হয়ে থাকা খোশগল্প সেরে নিচ্ছিলেন। তেমনই এক মুহূর্তের ছবি এটি। মায়ের সঙ্গে যে রাশিদদা’র অহরহ মোলাকাত হতো, তেমন নয়। আমি আর দূর্বা বরং অনেক বেশি আড্ডায় সামিল হতাম, কাজে অকাজে নানা জায়গায় দেখাও হয়ে যেত। কিন্তু গানের মানুষদের মধ্যে, একই শিল্পে নিবেদিত শিল্পীদের মধ্যে এক ধরনের অলিখিত যোগাযোগ থাকে। বাতাসে বা তরঙ্গে সে-যোগাযোগ ঠিক বাহিত হয়, আমরা টের না-পেলেও।

আমাদের যখন কৈশোর, তখন থেকে কলকাতার আসরে গাইছেন তরুণ রাশিদ। মায়েদের প্রজন্মের যাঁরা গানবাজনা করেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন, অসামান্য এক উত্তরসূরী এসে গেছে মেহফিলে। সুরের মধ্য দিয়ে তখনই এক যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। গেছিলও। তারপর বহু বছর কেটে গেছে, মা অনেকদিনই মঞ্চ থেকে সরে এসেছেন, বাড়িতে শেখানোও বন্ধ করেছেন বেশ কিছু বছর। কিন্তু গানবাজনার খোঁজখবর নেওয়াটা ছাড়েননি। বিশেষ করে, রাশিদদা’র গানবাজনার খবর। আমরা কোনও আসরে যাচ্ছি শুনলেই এ-কথা জিগ্যেস করাটা স্বভাব হয়ে গেছে, ‘রাশিদ গাইছে নাকি আজ?’ আর যদি উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’, তাহলে যত রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, মা’র প্রশ্ন থাকে, ‘কী গাইল আজ রাশিদ?’ তখন রাগের, বন্দিশের ফিরিস্তি দিয়ে তবে নিস্তার। বুঝতে পারি, মঞ্চ থেকে বহু দূরে চলে আসা একজন শিল্পী তাঁর অনুজের গানবাজনা কল্পনা করছেন, ভেবে নিচ্ছেন তানপুরো’র চনমনে বেজে ওঠা আর রাশিদদা’র গমগমে জোয়ারিদার গলা।

যে-সন্ধের ছবি এটা, তারপর থেকে মা আর বিশেষ বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেননি। দফায় দফায় অসুস্থতা তাঁকে পীড়া দিয়েছে অনেক, আজ প্রায় শয্যাশায়ী। কয়েক মাস আগে অবধি সারা সকাল খবরের কাগজ পড়তেন, রেডিও শুনতেন, দুপুরটায় উপন্যাস বা ছোট গল্প। শারীরিক দুর্বলতায় সেসবের পাটও চুকেছে। টেলিভিশনে খবরটুকুও আর দেখেন না। এতদিন আক্ষেপ হতো এ-কথা ভেবে। কাল প্রথমবার মনে হলো, একদিক থেকে ভালই হয়েছে। এই যে দু’বছর হয়ে গেছে সেই সন্ধের পর, এর মধ্যে মাঝেমাঝেই মা জিগ্যেস করেছে, ‘হ্যাঁ রে, রাশিদ কেমন আছে?’ সব সময়ে বলতাম, ‘ভাল আছে’। অসুস্থতার যে-খবর আমরা শুনেছিলাম, তা মা’কে সাহস করে জানাতে পারিনি। আর গতকাল যখন রাশিদদা’র বিদায়ের খবরে সংবাদমাধ্যম উপচে উঠছে, সবটা বুঝেও আমরা নিজেদের বুঝিয়ে উঠতে পারছি না, তখন একইসঙ্গে এও ভাবছি যে, মা’কে কিছুতেই জানানো যাবে না। এই অশক্ত শরীর আর দুর্বল মনের বৃদ্ধাকে এমন শোক-সংবাদ না-ই বা দিলাম।

আজও মায়ের ঘরে কাগজ ঢোকেনি, রেডিও বা টেলিভিশন চলেনি। আজ, যখন সারা পৃথিবী জেনে গেছে উস্তাদ রাশিদ খান আর নেই, আমার মা দিব্যি জানে, রাশিদ আছে। গাইছে। আড্ডা দিচ্ছে। বহাল তবিয়তে আছে। থাকুক। ওভাবেই থাকুক। এই বিশাল গ্রহের এক কোণে একটা ছোট্ট ঘরে, এই বিপুল জনসংখ্যার মাত্র একজনের মনে সবদিক থেকে বেঁচে থাকুক রাশিদদা। কেননা, ভ্রমের মৃত্যু নেই। আমার বারবার মনে পড়ছে Wolfgang Becker-এর সেই অসামান্য ছবি ‘Goodbye, Lenin!’-এর কথা, যেখানে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসা অসুস্থ মায়ের চারপাশে এক পুরনো পৃথিবী তৈরি করে রাখছে তার ছেলে, মা যাতে টের না পান যে, ইতিমধ্যে কম্যুনিজম-এর পতন ঘটে গেছে।

যতদিন পারব, গানবাজনা শুনে বেড়াব আমরা। রাশিদদা’র মতো গান, জানি, আর কেউ উপহার দিতে পারবে না। তবু, নেশা তো, শুনে যেতেই হবে। আর যতদিন মা আছেন, বাড়ি ফিরে শোনাতেও হবে, কী কী শুনলাম। তারপর আসবে সেই অবধারিত প্রশ্ন, ‘আজ রাশিদ গায়নি?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মা’কে বলতে হবে, ‘হ্যাঁ মা, রাশিদদা গাইল তো, একেবারে শেষে’। শুনে স্বস্তির হাসি ফুটিয়ে মা আবার জিগ্যেস করবেন, ‘কী গাইল আজ রাশিদ?’ আমি আরেকটু সময় নিয়ে বলব, ‘এই তো, প্রথমে বাগেশ্রী, তারপর সাহানা, শেষে মিশ্র পাহাড়ি’। এই খবরটুকুই মায়ের ঘুমপাড়ানি গান হয়ে থাকবে, বাকি জীবন। আর মা যতদিন থাকবেন, আমাদের বাড়িতে একখানা সুরেলা মিথ্যে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াবে। যার ডাকনাম রাশিদ।

 

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199