ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ৩৩

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 27 Oct 2022

2305 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

তেত্রিশ.

মায়ের কথা - তিন.

এমন ধরনের ঘটনা মা আরও ঘটিয়েছেন একাধিকবার। আমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে একটা ঘটনা শুনেছিলাম একবার বিলেত থেকে দেশে এসে। মা ওর সঙ্গেই থাকতেন, আগেই বলেছি। ডুয়ার্স-এর মালবাজার টাউনে। মায়ের নিয়মিত অভ্যাস ছিলো সকালবেলার চা-টা খাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য হাঁটতে বেরোনো। কাঁধে একটা ছোট ঝোলাব্যাাগ নিতেন, যার মধ্যে থাকতো অল্প কিছু টাকা ভরা বটুয়া, ছোট্ট একটা জলের বোতল, হাতমুখ মোছার জন্য ছোট তোয়ালে এইসব জিনিষ। হাঁটা শেষ করে ফিরে আসতে সময় নিতেন বড় জোর এক ঘন্টা বা তারও কম। এই রকমই এক দিন সকালে হাঁটতে বেরিয়েছেন। এক ঘন্টা কেটে গেলো, তারপর দু-ঘন্টা, এমনকী তিন ঘন্টাও। মা ফিরলেন না। আরও বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার ভাই খুঁজতে বেরোলো কোথায় গেলেন তিনি।
মালবাজারের বয়েজ্’ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হওয়ার সুবাদে সেখানকার প্রায় সবাই ভাইকে চেনে, খাতির করে। পথে দু-চারজন প্রশ্ন করলো,‘মাস্টারমশাই, আপনাকে যেন একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু হয়েছে নাকি?’
‘হয়েছে মানে, মা হাঁটতে বেরিয়েছেন রোজকার মতো প্রায় তিন ঘন্টারও আগে। এখনও ফিরছেন না। তাই....’
সবাই বললো, ‘সে কী! আচ্ছা, আপনি বাড়ি যান, আমরা দেখছি।’

খানিক বাদে একজন এসে বললো, ‘মাস্টারমশাই, ঐ অশোক নামে ছেলেটা বলছে সকাল সাড়ে-সাতটা নাগাদ ও নাকি দেখেছে আপনার মা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘তাই নাকি! ডাকো তো অশোককে, ওকে সঙ্গে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে যাই একবার।’
বাস স্ট্যান্ডের কর্মীদের প্রশ্ন করে জানা গেলো মায়ের মতো চেহারার একজন বয়স্কা মহিলা দূর পাল্লার একটা বাসে উঠেছেন সকাল আটটার কিছু আগে। কোথায় যাওয়ার বাস ছিলো সেটা তারা ঠিক লক্ষ্য করেনি, তবে ঐ ধরনের তিন-চারটে বাস ছাড়ে ঐ সময়ে।

এইটুকু খবর থেকে মায়ের সঠিক হদিশ বার করা কঠিন। ভাইয়ের স্কুলের অন্যান্যরা পরামর্শ দিলেন থানায় জানানোর। প্রথমটা ভাই বললো সেটা করার আগে ও আরো কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে চায়, কারণ অতীতেও মা-কে নিয়ে এমন কা- দু-একবার ঘটেছে। তা সত্ত্বেও অন্যদের পীড়াপীড়িতে থানায় গিয়ে বড়বাবুকে সব খুলে বললো। বড়বাবুও তো ওকে চিনতেন, বললেন লিখিত ডায়েরী করার দরকার নেই, তিনি খোঁজ লাগাচ্ছেন। সেদিন আর কোন খবর পাওয়া গেলো না। অবশিষ্ট দিন আর ঐ রাতটা উদ্বেগেই কাটলো। পরদিন একটু বেলার দিকে থানার একজন লোক এসে ভাইকে বললো, ‘স্যার, আপনার মা কাঠমান্ডুর বাসে উঠেছিলেন জানা গেছে।’

কাঠমান্ডু! সে তো নেপালে। সেখানে খোঁজ নেওয়া যাবে কীভাবে? অবশ্য মায়ের যা স্বভাব, তাতে মালবাজার থেকে কাঠমান্ডু পৌঁছে যাওয়া তাঁর জন্য অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু সেখানে গিয়েও খোঁজ পাওয়া যাবে কোথায়? তাছাড়া কাঠমান্ডু যাওয়ার সেদিনকার বাস চলে গেছে সকাল আটটায়, পরের দিনের বাসের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায়ও নেই।
কাঠমান্ডু যেতে হলো না অবশ্য শেষ পর্যন্ত, কারণ মা ফিরে এলেন বহাল তবিয়তে সেদিনই সন্ধ্যাছ’টার দিকে। বাস স্ট্যান্ড থেকে রিক্শা চড়ে বাড়ি পৌঁছে হাসিমুখে বললেন: ‘পশুপতিনাথ দর্শন করে এলাম।’ হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে, গুছিয়ে বসে চা খেতে খেতে বিস্তারিত বিবরণ দিলেন তাঁর এই ঝটিকা সফরের।
গতকাল সকালে হাঁটতে হাঁটতে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত গেছেন। দেখেন একটা বাস ছাড়ার জন্য তৈরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তারকনডাক্টার বাইরে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে , ‘কাঠমান্ডু! কাঠমান্ডু! জলদি আসুন, বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে -
‘কাঠমান্ডু! সেখানেই তো পশুপতিনাথ মন্দির! কতদিন ধরে আমার শখ এই মন্দির দর্শন করা। যেতেই হবে, আজই, এক্ষুনি ’
তাড়াতাড়ি টিকিট ঘরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাঠমান্ডুর টিকিটের কত দাম?’
‘চল্লিশ টাকা।’ (সাড়ে-তিন দশক আগে ভাড়া ঐ রকম কমই ছিলো। আর ঐ সময়ে উত্তরবঙ্গ থেকে সরাসরি কাঠমান্ডু যাওয়ার বাস সার্ভিস্-ও ছিলো, যেটা পরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে শুনেছি সম্প্রতি নাকি এই পরিষেবা আবার শুরু হয়েছে।)

সে যাই হোক, ‘ভাড়া চল্লিশ টাকা’ মানে যাওয়া-আসা ধরে আশি টাকা। একটা রাত তো থাকতেও হবে ওখানে মালবাজারে ফিরে আসার আগে, তারও খরচ আছে। অত টাকা তো সঙ্গে নেই। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো মায়ের। আজ আর হবে না, আরেক দিন চেষ্টা করতে হবে।ফিরেই আসছিলেন, হঠাৎ মনে পড়লো, মনু নামে যে কিশোরীটি রোজ তাঁর টুকিটাকি কাজে সাহায্য করতে আসে তার জন্য একটা জামা কিনবেন বলে দেড়শো টাকা নিয়েছিলেন ছেলের কাছ থেকে, সেটাও তো সঙ্গে থাকার কথা। বটুয়া খুলে দেখলেন, আছে, সব মিলিয়ে প্রায় দুশো টাকা তো হবেই। ব্যস্, আর চিন্তা কীসের? ঝট্পট্ কাঠমান্ডুর টিকিট কিনে বাসে উঠে বসলেন। বাড়ি গিয়ে বলে আসা যে তিনি নেপালে বেড়াতে যাচ্ছেন, সে’কথা তাঁর মাথাতেই এলো না। এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো মায়ের চরিত্রেই ছিলো না কোনও দিন।
এর পর আর কী? ঘন্টাচারেক বাদে কাঠমান্ডুতে নামা, একটা ধর্মশালা খুঁজে বার করা, তারপর বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পশুপতিনাথ মন্দির আর বিগ্রহ দর্শন। ধর্মশালায় রাতটা কাটিয়ে পর দিন কাঠমান্ডুতে একটু ঘোরাঘুরি করে বেলা একটায় আবার বাসে চেপে মালবাজার ফেরা। কোনই সমস্যা হয়নি, সহজভাবেই নিষ্পন্ন হয়েছে দিন দেড়েকের কাঠমান্ডু সফর। ছেলে অহেতুক দুশ্চিন্তা করছিলো। তা করুক, যার যেমন স্বভাব। মায়ের নিজের মনপ্রাণ তো পরিতৃপ্ত। কতদিনের একটা সাধ মিটলো বলে কথা! (চলবে. . . .)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199