ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ২৮

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 8 Sept 2022

1735 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

আটাশ.

(পূর্ববর্তী এপিসোডের পরের অংশ): এমন পকেটমার বা ব্যাগমারের হস্তশিল্পের শিকার বিলেতে থাকতে আর কখনও হইনি, তবে একটু অন্য ধরনের ছিঁচকে রাহাজানির ভুক্তভোগী হয়েছি কয়েকবারই। বিলেতের শহরগুলোতে, ছোট বা বড় দুই ধরনেরই, অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি রাস্তার ধারে কিংবা অন্য কোন জায়গায় কিছুক্ষণ ধরে পার্ক করে রাখা গাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরের জিনিষ চুরি করা একটা সাধারণ দুষ্কর্ম। মাদকাসক্ত তরুণ-যুবকরাই সচরাচর এই কাজটি করে থাকে নেশার রসদ জোগাড় করার উদ্দেশ্যে। বিলেতের শহুরে এলাকার অধিকাংশ বাড়িতেই গাড়ির রাখার গ্যারাজ নেই, বাড়ির সামনের রাস্তাতেই গাড়ি পার্ক করতে হয়, সুতরাং তার জানালার কাঁচ ভেঙে চুরি বেশ সহজসাধ্য কাজই। এইভাবে লন্ডনে আমাদের গাড়ি থেকে চুরি হয়েছে বেশ কয়েকবার। একবার যেমন, সন্ধ্যায় আমাদের পাড়ার কাছেই একটা রেস্তোরাঁতে খেতে গিয়েছি আমরা, গাড়ি রেখেছি তাদেরই পাকিং লট্-এ।ঘন্টা দেড়েক বাদে বেরিয়ে এসে দেখি গাড়ির একটা জানালার কাঁচ ভাঙা, ভিতরের দু-চারটে জিনিস উধাও। একটা সুবিধা হলো যে এ’সব ঘটনার জন্য বীমা কোম্পানীর কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানালে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটা পাওয়া যায় অথবা কোম্পানী দ্রুত ভাঙা জানালা সারিয়ে দেয়।

একটা ঘটনার কথা বলি। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ গ্লস্টারশায়ার এলাকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব ওয়েলস্-এ যাওয়ার পথে ‘সেভার্ন’ নদীর উপরে বিরাট একটা সেতু আছে। খুবই সুন্দর দেখতে এই সেতু এবং তার আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যও অতি মনোরম। একবার আমাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতৃপ্রতীম কৌশিকশংকর দাস (ডাকনাম ‘শাম্মী’, ঢাকার জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক) ওর স্ত্রী ‘চুমকি’কেনিয়ে আমাদের কাছে বেড়াতে এলো। শাম্মী এক সময়ে লন্ডনে ছিলো কয়েক বছর, সেই থেকেই ওর সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা। যাই হোক, ওদের শখ সেভার্ন সেতু দেখতে যাওয়ার এবং এই শখ মেটানোয় আমাদের কোন আপত্তি হলো না কারণ আমরাও সুন্দর কোন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ কখনও হাতছাড়া করতাম না। সুতরাং একটা দিন স্থির করে সেতুর কাছাকাছি এলাকায় রাত্রিবাসের জন্য একটা হোটেল ঠিক করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। যথাস্থানে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। হোটেলে চেক্-ইন করার খানিক পর আমরা রওনা হলাম অদূরবর্তী সেভার্ন নদীর উদ্দেশ্যে।

নদী, সেতু, চারপাশের দৃশ্যাবলী সবই মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার মতোই সুন্দর। কাছের পার্কিং চত্বরে গাড়ি রেখে আমরা সেতুর উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে তার মাঝামাঝি পর্যন্ত গিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম ক্যামেরায়। আবার গাড়ির কাছে ফিরে এসে দেখলাম পাশেই একটা ছোট টিলার মতো রয়েছে গাছপালায় ঘেরা, তার মাথায় চড়ার পথও রয়েছে। টিলার মাথা থেকে চারপাশের দৃশ্য নিশ্চয় আরো দৃষ্টিনন্দন হবে, তাই টিলায় চড়তে সকলে সাগ্রহে রাজি হলো। তার আগে সবাই নিজের নিজের হাতব্যাগ, কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ ইত্যাদি গাড়ির বুটে রেখে দিলাম, ভাবলাম গাড়ির দরজা তো লক্ করাই থাকবে, অতএব জিনিষপত্র নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু কয়েক পা এগোনোর পর হঠাৎ কী যেন একটা ভেবে পিছিয়ে এসে আমি গাড়ির বুট খুলে আমার ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝোলালাম।

টিলার মাথায় চড়ে, এদিক-ওদিক একটু ঘোরাঘুরি করে, আরও এক দফা ছবিটবি তোলার পর নিচে নেমে আসতে আমাদের সময় লাগলো বড় জোর মিনিট চল্লিশ। গাড়ির সামনে এসে তো আমাদের সকলের চক্ষু চড়কগাছ! গাড়ির পিছন দিকের একটা জানালার কাঁচ ভাঙা, বুট খানিকটা ফাঁক হয়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি পুরোটা খুলে দেখি ভেতরে রাখা হাতব্যাগ বা কাঁধব্যাগ একটাও নেই। নিশ্চয়ই আমাদের উপরে নজর রেখেছিলো কেউ আড়াল থেকেআর আমাদের সংক্ষিপ্ত অনুপস্থিতির সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেনি। একমাত্র আমার ব্যাগই আমার কাঁধে ঝোলানো, বাকি তিনজনেরই জিনিষ উধাও, যার মানে তাদের নগদ টাকা, ব্যাংকের কার্ড, অন্যান্য টুকিটাকি সব কিছুই হাতছাড়া। অগত্যা বেড়ানোর আনন্দ ভুলে হোটেলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না সেই মুহূর্তে। আমাদের দুর্দশার কথা শুনে হোটেলের কর্মীরা দুঃখপ্রকাশ করে পরামর্শ দিলেন থানায় গিয়ে একটা ডায়েরী করার। থানায় যাওয়ার পথ জেনে নিয়ে গেলাম সেখানে। একজন পুলিশ অফিসার সমস্ত বিবরণ লিখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের কত দিন এখানে থাকার প্ল্যান?’ আমি বললাম, ‘আগামী কাল সকালে ব্রেক্ফাস্টের পর পরই হোটেল থেকে চেক্-আউট করার কথা ভেবে রেখেছিলাম।’ অফিসার বললেন, ‘কালকের দিনটা থেকে যেতে পারলে ভালো হয়, তোমাদের জন্য কোন খবর যদি পাওয়া যায়। তোমাদের কারো মোবাইল নম্বর দিয়ে যাও।’ তাঁর কথায় সম্মতি জানিয়ে আবার হোটেলে ফিরে গাড়ির বীমা কোম্পানীকে ফোন করে দুর্ঘটনার কথা (দুর্ঘটনা ছাড়া আর কী?) জানালাম। তারা স্থানীয় একটা গাড়ি মেরামতের গ্যারাজের ঠিকানা দিয়ে সেখানে যেতে বললো। সেখানে যাওয়ার পথনির্দেশ পাওয়া গেলো হোটেল থেকে,তবে জায়গাটা খুব কাছে নয়। তাছাড়া ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়ে আঁধার নেমে এসেছে, তাই আমরা ঠিক করলাম সন্ধ্যার পর অচেনা ঠিকানায় যাওয়ার চেষ্টা না করে কাল সকালে যাওয়াই শ্রেয়।

পরদিন গ্যারাজে গেলে সেখানকার কর্মীরা বললেন,‘আপাতত জানালায় নতুন কাঁচের বদলে অভঙ্গুর প্ল্যাস্টিকের শীট লাগিয়ে দিচ্ছি। তার জন্য কোন খরচ দিতে হবে না। তোমরা তো আগামী কালই লন্ডনে ফিরছো, সেখানে পৌঁছে কোম্পানীকে ফোন করবে Ñ আমরাও জানিয়ে দিচ্ছি ওদের। কাল রাতেই কিংবা তোমাদের সুবিধামতো সময়ে কাঁচ লাগিয়ে দিয়ে যাবে ওরা।’ এই প্রস্তাবেইরাজি হলাম। জানালার কাজ শেষ করতে গ্যারাজ খুব বেশী সময় নিলো না। সেখান থেকে বেরিয়ে যখন হোটেলে ফিরছি তখন আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো Ñ থানা থেকে ফোন করছে পুলিশ: এখনই থানায় চলে এসো। তোমাদের হারানো জিনিষ পাওয়া গেছে।

থানায় ঢুকে দেখি ঊর্মি, শাম্মী আর চুমকির ব্যাগ একটা টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা। অফিসার বললেন যেভোরের দিকে ‘মর্নিংওয়াক্’ করতে বেরোনো এক ভদ্রলোক পথের ধারে এই ব্যাগগুলো পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে থানায় জমা দিয়ে গেছেন:‘ভেতরের জিনিষ তোমাদের দেওয়া বিবরণের সঙ্গে মিলেও গেছে, তোমরাও মিলিয়ে দেখো। তবে হ্যাঁ, যে তিনটি পার্স ভেতরে পাওয়া গেছে তাদের কোনোটার মধ্যেই কোন নগদ টাকা নেই, যদিও ব্যাংক কার্ডগুলো আছে। সেটাই স্বাভাবিক অবশ্য, যে বা যারা গাড়ি থেকে ব্যাগ হাপিস করেছিলো তারা জানে যে ‘পিন’ ছাড়া ঐসব কার্ড তারা কাজে লাগাতে পারবে না।’

অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। সেদিন আর কোথাও বেরোনোর মেজাজ ছিলো না, হোটেলেই কাটালাম সময়। পরদিন সকালে ঘরভাড়া মিটিয়ে চেক্-আউট করার পালা। ভাগ্যিস্ টিলায় চড়ার আগের মুহূর্তে আমার ব্যাগটা বুট থেকে তুলে কাঁধে ঝুলিয়েছিলাম! কোন রক্ষাকর্তা উপদেবতা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘গার্ডিয়ান এঞ্জেল’ Ñ নিশ্চয়ই সে’সময়ে আমার পাশে ছিলেন অদৃশ্যভাবে। তা না হলে হোটেলের বিল মেটাতাম কীভাবে?

সে‘দিন সন্ধ্যার মধ্যে লন্ডনে ফিরে এলাম আর নতুন কোন বিপর্যয় ছাড়া। পর দিন বীমা কোম্পানীর লোক এসে গাড়ির জানালার কাঁচ বদলে দিয়ে গেলো। ঊর্মির আর শাম্মীর ব্যাংক কার্ড পরীক্ষা করে জানা গেলো সেগুলি ঠিকই আছে, কোনরকম অবৈধ ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়নি। সুতরাং নগদ টাকা খোওয়া যাওয়া ছাড়া আর তেমন কোন ক্ষতির মুখেও কাউকে পড়তে হলো না।

গাড়ির জানালা বা দরজার লক্ ভেঙে ভিতরের জিনিষ চুরি ইংল্যান্ডে অতি সাধারণ একটা ঘটনা। সে’দেশে বোধ করি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে নিয়মিত গাড়ি চালিয়ে নানা জায়গায় যায় এবং সর্বজনীন এলাকায় কমবেশী সময়ের জন্য গাড়ি পার্ক করে, অথচ গাড়ি থেকে এ’ভাবে জিনিষ খোওয়া যাওয়ার ভুক্তভোগী হয়নি। অ্যামেরিকায় কিন্তু এই দুষ্কর্মটি অপ্রত্যাশিতভাবে বিরল। প্রায় কেউই সেখানে প্রকাশ্য জায়গায় গাড়ি পার্ক করার পর তার দরজা লক্ করে না। ঊর্মি আর আমি একবার লন্ডন থেকে উত্তর অ্যামেরিকার বল্টিমোর শহরে গিয়েছি ক’দিনের জন্য। ঊর্মির এক বোন ঐ শহরটির দীর্ঘকালের বাসিন্দা। সেই সময়ে ওর এক ভাইও সেখানে থাকতো। আমার ঐ শ্যালকের সঙ্গে আমি প্রায়ই এদিক-ওদিক ঘুরতে যেতাম গাড়িতে। যেখানেই যাই, কোন শপিং মলে বা সুপার-মার্কেটেবা শহরের বাইরে সমুদ্রতটে, গাড়ি পার্ক করার পর তার দরজা লক্ না করেই শ্যালক বলতো: ‘চলুন Ñ’ আর হন্হন্ করে এগিয়ে যেতো। প্রথমবার যারপরনাই অবাক হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম: ‘গাড়ি লক্ করলে না?’ উত্তরে তাচ্ছিল্যভরে একটা হাত নেড়ে ও বললো: ‘নাঃ, দরকার নেই।’ ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতায়অভ্যস্ত আমি এই ধরনের দুঃসাহসিকতার নির্দশনে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য বুঝেছি এ’দেশে এটাই দস্তুর। যে কোন কারণেই হোক, গাড়ি ভেঙে চুরি এখানে অভাবনীয়।
সত্যি কথা বলতে কী, এই ধরনের চৌর্যবৃত্তির প্রবণতা ইংল্যান্ডে তথা গোটা ব্রিটেনে যতটা বাড়াবাড়ি রকমের, ততটা আমি আর অন্য কোথাও দেখিনি। আমাদের দেশে, বিশেষত কলকাতায়, তো নয়ই। বিলেত থেকে ফেরার পর যে ক’বছর এই শহরে বাস করছি, কখনও আমাদের কানে আসেনি যে রাস্তায় পার্ক করা অবস্থায় পরিচিত, অথবা অপরিচিত, কারো গাড়ির দরজার লক্ ভেঙে ভিতরের জিনিস চুরি হয়েছে। অথচ ছুটকোছাটকা অন্য ধরনের দুষ্কর্ম তো অহরহই ঘটছে। সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে হয়তো এর কোনরকম ব্যাখ্যা আছে। সেটা জানতে পারলে ভালো হতো।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199