ডিসেম্বরের সেই দিনরাত্রিগুলি

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 5 Dec 2024

2155 বার পড়া হয়েছে

Shoes

এক.

আমি তখন স্কুলপড়ুয়া বালক। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। অবরুদ্ধ, বিবর্ণ ঢাকা শহরে শীত নেমেছে। তখন অবশ্য অক্টোবর থেকেই একটু একটু করে শীত দখল নিতে শুরু করতো। ডিসেম্বরে পৌঁছে তো পুরো শীত। স্কুলের পাট চুকেছে সেই মার্চ মাসেই। স্কুলের সেই নেভী ব্ল সোয়েটার গায়ে দিনের বেলা বসে থাকি বারান্দায়। সবে শহরের এক পাড়া থেকে বাড়ি বদলে এসেছি অন্য পাড়ায়। কিন্তু তারপরেও রাতে বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছে না বাবার পক্ষে। গোয়েন্দা দপ্তরে চাকরি করা বড় খালু সেপ্টেম্বর মাসে এসে জানিয়ে গেছেন, পাকিস্তান সরকার বিরোধীদের তালিকায় বাবার নাম আছে; রাতে বাড়িতে না থাকাই ভালো। সেই থেকে আমাদের পুরো পরিবার রাতে ফেরারী।

রাতগুলো তখন ছিলো ভয়াল, নির্মম আর অবিশ্বাসী। ঘাতকদের পদশব্দ এড়াতে পালিয়ে পালিয়ে রাত কাটাতে গিয়ে সবাই ক্লান্ত। কিন্তু উপায় তো নেই। সন্ধ্যা নামার মুখেই বের হয়ে পড়তে হতো বাসা থেকে। শীতের বিকাল দ্রুত আয়ু ফুরিয়ে সন্ধ্যায় সমর্পিত হয়। বাবা, মা আর আমি কখনো পায়ে হেঁটে আবার কিছুটা পথ রিকশা করে পৌঁছতাম কোনো এক আত্মীয়র বাড়িতে। সন্ধ্যায় কারফিউ। বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ। তখন বেশিরভাগ মধ্যবিত্তের বাড়িতে কাঠের জানালা থাকতো। ইলকট্রিসিটি নেই। বিকালে চলে গিয়ে ভোর রাতের আগে আর ফিরতো না। হ্যারিকেন আর মোমবাতিই একমাত্র ভরসা। সেই আলোতেই কোনোরকমে রাতের খাওয়া শেষ করে মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়া। কিন্তু ঘুম আসে না। বাইরে শীতের রাত্রি বয়ে যায়। সামান্য কোনো শব্দে চমকে উঠতে হয়। বুটের শব্দ না তো?  এই বুঝি রাজাকারের দল এসে দরজায় ধাক্কা দেবে। তখন ঢাকার বাতাসে অনেক মানুষকে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়ার কাহিনিগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। মৃত্যুভয় তাড়া করে ফিরছে আমাদের।
ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের রাত্রিগুলো মৃতের হাড়ের মতো সাদা; সামান্য হাওয়াতেও কেঁপে ওঠে। মোমবাতি পুড়ে শেষ হয়, হ্যারিকেনের কেরোসিন ফুরিয়ে যায় অবরুদ্ধ শহরে মৃত্যুর প্রহর আর শেষ হয় না।
মনে পড়ে, তখন গভীর রাতে আচমকা বোমার বিষ্ফোরণ আর একটানা গুলির শব্দে জেগে উঠতাম। তখন খুব কোনো খাবার থাকতো না বাড়িতে। অন্যের আশ্রয়েও খাবার জুটতো না। বহুদিন শুধু ঠাণ্ডা ভাত আর ডাল থাকতো খাদ্য তালিকায়।
সেই ডিসেম্বরের দিনরাত্রিগুলোতে তবুও মানুষ শত্রুর বিনাশ দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। স্বপ্ন দেখতো একটা স্বাধীন দেশের। মানুষের ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে এই দেশে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিলো এই ডিসেম্বরেই। ডিসেম্বর মাস ক্যালেন্ডারে ফিরে এলেই সেইসব স্মৃতি মনের মধ্যে ভিড় জমায়। মনে হয়, এক অশ্রুনদীর তীরে জেগে উঠলাম আবার।(চলবে)

ছবিঃ গুগল ও প্রাণের বাংলা

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199