প্রিয় আজম ভাই...

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 18 Jan 2024

3010 বার পড়া হয়েছে

Shoes
আশিকুজ্জামান টুলু

দেশের প্রখ্যাত মিউজিশিয়ান এবং গায়ক আশিকুজ্জামান টুলু। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে আছেন কিন্তু গানের পৃথিবীর সঙ্গে রয়েছে তার নিয়মিত যোগাযোগ।  লেখালেখির সঙ্গেও তার নিযমিত বসবাস এবার প্রাণের বাংলায় গান আর গান বিষয়ক নানান ভাবনা নিয়ে সময় পেলেই লিখবেন তিনি।

আজম ভাইকে সবাই গুরু বলতো কিন্তু আজম ভাইয়ের প্রাত্যহিক জীবনধারায় উনার ভক্তদের গুরু নামকরনের এক চিলতে প্রভাব পড়েনি । অর্থাৎ এতই সাধারণ জীবন যাপন করে গিয়েছেন এই ভদ্রলোক যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন ।

একবার কমলাপুরে উনার বাসায় বউসহ গিয়েছি । বাইরের রুমে অপেক্ষা করছি, হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে আজম ভাই বলে উঠলেনঃ

টুলু ভিতরে আহো ।

আমি ভিতরে গিয়ে উনার বেডরুমে বসলাম । আমি একটু অপ্রস্তুত থাকলেও উনি একেবারেই স্বাভাবিক ছিলেন । জিজ্ঞাসা করলেনঃ

চা খাইবা?

আমিঃ না আজম ভাই ।

আজম ভাইঃ আরে খাও মিয়া, কিচ্ছু হইবোনা, ওয় দুই কাপ চা লইয়া আয় । (একটা ছেলেকে বললেন)

এই যে তার অনাড়ম্বর আচরন, সীমাবিহীন কাছে টেনে নেওয়ার আহবান, এই বিষয়গুলিই তাকে সবার কাছে গুরু বানিয়ে দিয়েছে যে গুরুর কাছে প্রেম শেখা যায়, যে গুরুর কাছে ভালোবাসা শেখা যায়, যে গুরুর কাছে প্রাপ্তি হয় মনুষ্য জীবনে ।

আজম ভাই আমার স্বপ্নপুরুষ ছিলেন । এই ছোট্ট জীবনে বাংলা রক প্রথম শুনেছি আজম ভাইয়ের গানে । দুপুর আড়াইটায় রেডিও বাংলাদেশের ফিলিপস শতরূপায় যখন বেজে উঠতো “আসি আসি বলে তুমি আর এলেনা”, আমিসহ আমার বিশ্বাস আমাদের বয়সের অগনিত আজম শ্রোতারা পাগল হয়ে যেতো । কি যেন এক অদ্ভুত টান ছিলো উনার ঐ টাইপের মিউজিকে । হ্যাঁ তখন ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ সবাই স্টার এবং সবাই সমান তালে গান গেয়ে যাচ্ছেন । বাকী চারজনের গানের সঙ্গে আজম ভাইয়ের গানের কোথায় যেন এক বিরাট ফারাক, কি যেন আছে আজম ভাইয়ের গানে, কেন যেন পাগলের মতো টানে, গাইতে গেলেই চলে আসে মুখে “ওরে সালেকা ওরে মালেকা”। বিষয়গুলো ঘটছিলো সেই লেট সেভেন্টিজে ।

যখন আর্লি এইটিজে আমি একটু সুযোগ পেলাম মিউজিক ডিরেকশন করার অর্থাৎ দু’জন ব্যাক্তিগত উদ্যোগে আজম ভাইয়ের অ্যালবামে টাকা বিনিয়োগ করতে চাইলেন এবং আমাকে বললেন ক্যাসেট করতে, আমি সঙ্গে সঙ্গে আজম ভাইকে প্রস্তাব দিলাম এবং আজম ভাই খুব সহজে আমার মতো অপরিচিত আনাড়ি মিউজিসিয়ানের কথায় বিনা বাক্যে উনার পুরনো গানগুলির নতুন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে নতুন অ্যালবাম  করতে রাজী হয়ে গেলেন । ঐ দুইজন ছিলেন আমার বন্ধুর বড়বোন বন্যা আপা এবং পপি আপা । বলে রাখা ভালো যে ওটাই ছিলো আজম ভাইয়ের প্রথম ক্যাসেট ফরম্যাটের অ্যালবাম । এর আগে ক্যাসেট ফরম্যাটের অ্যালবাম উনার বের হয় নাই । কারন মৌলিক গানের অ্যালবাম ক্যাসেট ফরম্যাটে বের হওয়া শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে । তার আগে ইন্ডিয়ান শিল্পীদের এই গান সেই গান জড়ো করে বিভিন্ন ক্যাসেটের দোকান নিজেরা ক্যাসেটে কপি করে বিক্রি করতো এবং বর্তমানের মতো কোন ক্যাসেট বা সিডি বা অ্যালবাম প্রোডিউসার কিংবা প্রোডাকশন কোম্পানি ছিলোনা ।    

আসলে বিভিন্ন প্রসঙ্গ এসে পড়ছে কারন আজম ভাইকে নিয়ে লিখতে গেলে এতো বিষয় চলে আসে, যা এড়ানো যায় না । কারন উনি বিশাল একজন মানুষ ছিলেন যার ব্যাপ্তি এবং কন্ট্রিবিউশনের কথা আজকের কোন রক ব্যান্ড অস্বীকার করতে পারবে না । বাংলায় যে রক হয় সেটা আজম ভাই শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন আমাদের এবং আমাদের আগের প্রজন্মকে । আসলে উনাদের পরিবারের বিরাট অবদান রয়ে গিয়েছে আমাদের দেশের মিউজিকে । অনেকে হয়তো জানেনা যে আজম ভাইয়ের আপন বড়ভাই ছিলেন দেশবরেণ্য  প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আলম খান ।

আজম ভাইয়ের কাছে আমি দুইটা বিষয় শিখেছি- প্রথমটা বাংলায় রক মিউজিক কিভাবে হতে পারে, দ্বিতীয়টা প্রেম । পৃথিবীর প্রতিটা মানবিক পদক্ষেপে প্রেম বিষয়টা যে কি, তা আজম ভাইয়ের গানে, কথা বলায়, আচরণে শিখে নিয়েছি ।

একটা ছোট্ট গল্প বলি । একবার আজম ভাইয়ের সঙ্গে রাজশাহীতে শো করতে গেলাম । আমি তখন আমার নিজের একটা সাউন্ড সিস্টেমে নিজেই সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করি । ঐ শোতে আমি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গিয়েছি । পৌঁছানোর পরই হলে গিয়ে ঝটপট আমার সিস্টেম রেডি করে ফেললাম, সাউন্ড ব্যালেন্স করে ফেললাম । কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে গেলো কনসার্ট । স্থানীয় দু’য়েকজন শিল্পী গাওয়ার পর আজম ভাই আসলেন । আজম ভাইয়ের কনসার্টে সারা হলে টইটুম্বুর অবস্থা, একটা পিপড়া পর্যন্ত ঢোকার কোন জায়গা নাই । আমি একেবারে সামনের সারির সিটের সামনে অর্থাৎ স্টেজের একেবারে সামনে আমার মিক্সার নিয়ে বসেছি । ছেলেপেলেরা অলমোস্ট আমার কাঁধে ভর দিয়ে অনুষ্ঠান দেখছে ।

আজম ভাই স্টেজে ওঠামাত্র সারা হল ফেটে পড়লো । একজন অহমবিহীন মানুষের প্রাকৃতিক অহম সারা হলকে কাঁপিয়ে দিলো । এদিকে অবশ্য আমারও কাঁপাকাঁপি অবস্থা কারন আমি শুধু ভাবছিলাম যদি একটা ধাক্কা কেউ পিছে থেকে দেয় তাহলে আমি আমার মিক্সার অ্যামপ্লিফায়ারের দোকানপাট নিয়ে পপাত ধরণিতল হয়ে যাবো । প্রোগ্রামতো দুরে থাক, পাবলিকের মাইর থেকে বাঁচতে কোন গ্রামে গিয়ে পালাতে হবে কে জানে!!

যাই হোক আজম ভাই প্রথম গানটা ধরা মাত্র মনে হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গিয়েছে ঐ হলে । মানুষের উন্মাদনা কন্ট্রোলে রাখা প্রশাসনের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না । প্রথম গান শেষ করে আজম ভাই কেন যেন নিজের সার্টটা খুলে অডিয়েন্সের দিকে ছুড়ে মারলেন । সেই সার্ট ধরার জন্য যে জোয়ার এলো, তাতে আমার প্রান ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড় হলো । কোনরকমে সামলে নিলাম । আজম ভাইকে ওভাবে খালি গায়ে দেখে একটু হাসি পেলো কারন বেচারা একেবারে রোগা ৩৫ । ঐ পর্যন্ত ঠিকই ছিলো কারন বিভিন্ন রকারদের সার্ট খুলে ফেলার একটা রেওয়াজ বরাবরই ছিলো । কিন্তু পরের পার্টটা দেখে আমি হাসবো নাকি সাউন্ড কন্ট্রোল করবো, বুঝতে পারছিলাম না । উনি স্টেইজের ঠিক পাশে দাঁড়ানো আমার সাহায্যকারী ছেলে মন্তাজকে বললেন,তোর গেঞ্জি দে ।

মন্তাজ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলো উনার দিকে এবং ঠিক বুঝতে পারলো না কি বলছেন উনি । উনি এবার চিৎকার করে বললেন,কিরে গেঞ্জি খুলছ না? গেঞ্জি দে তোর ।

মন্তাজ ভয়ে ভয়ে খুলে দিলো সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে কেনা লাল গেঞ্জি এবং সিনেমার সম্ভ্রমহানী হয়ে যাওয়া নায়িকাদের মতো করে দুই হাত বুকের কাছে ক্রস করে দাড়ালো এবং কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো । আমি ওকে চোখের ইশারায় শান্তনা দিলাম কিছুটা এভাবে, কোন ব্যাপার না, গুরু পরসে তোমার গেঞ্জি, তুমি স্বর্গে না গেলেও তোমার গেঞ্জি স্বর্গে চইলা যাইবো । 

গেঞ্জি পরে আজম ভাইকে আজব লাগছিলো কারন আজম ভাইয়ের হাইট অলমোস্ট ছয় ফিট আর আমার ঐ ছেলেটার হাইট অলমোস্ট পাঁচ ফিট । এখন পাঁচ ফিটের গেঞ্জি যদি ছয়ফিটের চেসিসে ফিট করা হয় তাহলে কেমন লাগতে পারে একবার ভেবে দেখেন । আজম ভাইকে দেখে মনে হচ্ছিলো লাল রঙের ব্লাউজ পরে আছেন এবং পেট অর্ধেকটা বের হয়ে আছে । আমি কাজ কি করবো, হাসতে হাসতে শেষ । কেন যে আজম ভাই মন্তাজের গেঞ্জি পরলেন বুঝতে পারলাম না । ঐবারই আমি প্রথম গিয়েছিলাম আজম ভাইয়ের সঙ্গে তাই প্রতিটা বিষয় খুব এনজয় করছিলাম ।

আজম ভাই ধরে ফেললেন অভিমানি । ব্যাস সব শেষ অর্থাৎ সারা হল মনে হলো ফেটে পড়লো একসঙ্গে । রকেটের বানানো লিডটা সমগ্র অডিয়েন্সকে পাগল করে দিলো । গান অর্ধেক পর্যন্ত যাওয়া মাত্র হলের পেছনের দিকে তুমুল মারামারি বেঁধে গেলো । একদল ছেলে তাদের প্রতিপক্ষ দলের এক ছেলেকে ছুরি মেরে দিয়েছে । ব্যাস সব পণ্ড । ধাক্কাধাক্কি মারামারির এফেক্ট আমার প্যানেল পর্যন্ত পৌঁছে গেলো । আমি দুই হাত এবং শরীর দিয়ে মিক্সারের ওপর শুয়ে পড়লাম যাতে কারও লাঠি বা চেয়ারের বাড়িটা মিক্সারে এসে না পড়ে । কি যে বোকা ছিলাম এখন ভাবি, নিজের মাথা না বাঁচিয়ে মিক্সার বাঁচাতে গিয়েছি!!

ওদিকে আজম ভাই গান থামিয়ে রীতিমতো বকাঝকা শুরু করলেন ঐ ছেলেগুলোকে যাতে ওরা একটু থামে । কে শোনে কার কথা, ওরা সমানে মারামারি চালিয়ে যেতে থাকলো । এরপর আজম ভাই সবচাইতে আশ্চর্যের একটা ঘটনা ঘটালেন । ঐ মুহূর্তে আমি বুঝতে পারিনি যে উনি এটা কেন করলেন । উনি স্টেজের এক কোনায় গেলেন এবং সেখান থেকে গোটা দুই তিন ডিগবাজী দিলেন এবং ডিগবাজী শেষ করে স্টেজ থেকে সোজা নেমে চলে গেলেন । পুলিশ এসে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলো । আমি আমার জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে শুধু একটা কথাই ভাবছিলাম উনি কেন ডিগবাজী দিলেন ।

পরেরদিন সকালে ফিরে আসার সময় এয়ারপোর্টে আজম ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম,আচ্ছা আজম ভাই আপনি ডিগবাজী কেন দিলেন?

আজম ভাই বললেন, ঐ হালারা গান শুনতে আসে নাই, মাইরপিট করতে আইছে, হালাগো মনে কোন প্রেম নাই । যেইখানে প্রেম নাই, সেখানে কি গানবাজনা হয়? সেখানে ম্যাক্সিমাম ডিগবাজী হইতে পারে । ঐ জন্যেই ডিগবাজিটা দিলাম ।

বয়স কম এবং বোঝা কম থাকায় উনার কথায় প্রচন্ড হেসেছিলাম । উনি কিন্তু কথাগুলো বলার সময় একটুও হাসেননি, উনি খুব সিরিয়াসলি বলেছিলেন । তবে এখন উনার ঐ ডিগবাজীর ফিলসফিটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছে, বুঝে গিয়েছি প্রেমের সংজ্ঞা কি, কেন প্রেম দরকার প্রতিটা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সংগীতে । যতদিন আমরা প্রেমবিহীন শিল্পচর্চা করবো, বিষয়টা কিছুটা ডিগবাজী দেওয়ার মতই হবে, কারন যে পৃথিবীতে প্রেম নাই সেখানে ডিগবাজী ছাড়া আর কোন কিছু দেওয়ারও নাই ।

ছবি: গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199