ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ২৬

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 25 Aug 2022

2555 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

ছাব্বিশ.
প্রায় বছর চল্লিশেক আগে, যখন আমার বসবাস ও কাজকর্ম কলকাতাতেই তখন, এবং তারও বছর দশেক পরে বিলেতে আরও একবার, যে দু’টি রহস্যময় বা ‘ব্যাখ্যার অতীত’অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো তাদের বিবরণ ইতোপূর্বে লিখেছি। একই গোত্রের তৃতীয় একটি অভিজ্ঞতা আরো সাম্প্রতিক কালের, আবারও কলকাতাতেই,যার বিবরণ এখন লিখছি। পাঁচ-ছয় বছর আগে আমি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম এবং দুই দফায় প্রায় দশ-বারো দিন আমাকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। প্রথম দফায় আমাদের ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে আমি ভর্তি হয়েছিলাম দক্ষিণ কলকাতার একটা মাঝারি আকারের হাসপাতালে। সেখানে আমার জন্য যে কেবিনের ব্যবস্থা হয়েছিল তার একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার। তিনতলায় পরিচ্ছন্ন সুসজ্জিত ঘর, ভেতরে ঢুকে ডানদিকের দেওয়ালে বাথরূম-টয়লেটের দরজা, তার বিপরীতে রোগীর খাট এবং তার ওপাশে পাতা একটা ডিভান যেটা রাতে রোগীর সঙ্গে কেউ থাকলে তার জন্য বরাদ্দ। ঘরে ঢোকার দরজার মুখোমুখি জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায় একটা দোতলা স্কুলবাড়ির খানিকটা অংশ আর বেশ বড় একটা খেলার মাঠ। জানালার পাশের দেওয়াল ঘেঁষে বসানো জামাকাপড় রাখার একটা ছোট কাবার্ড আর একটা টেবিল, জানালার নিচে একটা ছোট সোফা। খাটের পাশে ডিভানটার কাছে যেতে হয় দরজার বাঁ-দিকের দেওয়ালের সামনে দিয়ে, যেটা ডিভানের পেছনের দেওয়ালে কোনাকুনি মিশেছে। এত খুঁটিনাটি বিবরণ দেওয়ার কারণ কী তা একটু পরে বলছি।

ঐ হাসপাতালে আমি বেশ আরামেই ছিলাম, সুচিকিৎসা ও স্বাচ্ছন্দ্যের কোন অভাব হয়নি। নার্সদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রতি ঘন্টায় এসে দেখে যেতেন আমি, অর্থাৎ রোগী, ঠিক আছি কিনা। সমস্যা হচ্ছিল একটাই, তা হলো অসুস্থতার ধরনের জন্যই বোধহয় রাতে ঘুম আসতে চাইতো না মোটেই। এমনকি ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও প্রায় সারা রাতই জেগে থাকতাম। তেমনই এক রাতে, হাসপাতালে সম্ভবত সেটা আমার তৃতীয় বা চতুর্থ রাত, খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি, ঘুম আসছে না। কেবল নাইট-ল্যাম্প ছাড়া ঘরের আর সব আলো নেভানো। দরজা খোলা, তবে সেটার সামনে মোটা পর্দা ঝুলছে, নাইট-ল্যাম্পের মৃদু নীলাভ আলোয় ঘরের ভেতরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। সবই ঠিক আছে, কেবল আমার চোখে ঘুম নেই, মাথাটা গরম হয়ে উঠছে। হঠাৎ যেন দেখলাম দরজার পর্দার ওপাশ থেকে কেউ একজন ঘরে ঢুকে পড়লো। পর্দা সরিয়ে ঢুকলো বলে মনে হলো না, যেন পর্দার ভেতর দিয়ে এপাশে বেরিয়ে এলো। নার্সদের কেউ কী নিয়মমাফিক আমাকে এক নজর দেখে যেতে এসেছেন? তাকে দেখে কিন্তু নার্স মনে হচ্ছিল না কারণ তার পরনে নার্সদের ইউনিফর্মের বদলে অন্য ধরনের পোষাক। সে পরে আছে কোন গাঢ় রঙের পাতলুন, জীনস্ হতে পারে, তার ওপরে ঐ রঙেরই পুরো হাতা জ্যাকেট্, মাথা ঢাকা জ্যাকেটের হুড দিয়ে। পায়ের জুতোর রঙও কালোই মনে হলো। জ্যাকেটের হুডের নিচে তার মুখ খুব স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে তার গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। এত রাতে হাসপাতালের কেবিনে এ আবার কে? সে কিন্তু আমার দিকে একবারও তাকালো না, খাটের ওপর শায়িত আমার দেহটা যেন তার চোখেই পড়লো না। দরজার ঠিক ভেতরে সে দুই বা তিন সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর বাঁ-দিকে ঘুরে দেওয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে ডিভানের পেছনের দিকটায় যেখানে দু’টো দেওয়াল কোনাকুনি মিশেছে সেখানে পৌঁছে মিলিয়ে গেল। দেখে মনে হলো সে যেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতেই পা বাড়িয়ে দেওয়ালের গায়ে একটা দরজা দিয়ে কোথাও ঢুকে গেল। অথচ দেওয়ালের ঐ জায়গাটায় দরজা বা জানালা কিছুই নেই, সম্পূর্ণ নিরেট দেওয়াল। কান্ডটা কী হলো, কী দেখলাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না, শুধু বুঝলাম যে সে রাতে আর ঘুম আসার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বহুক্ষণ জেগে থেকে এই অদ্ভূত ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে প্রায় ভোরের দিকে ঘুমিয়েও পড়লাম। একটু বেলায় ঘুম ভাঙার পর টের পেলাম যে রাতের ঐ দৃশ্য আমার পরিষ্কার মনে আছে। তবুও ভাবলাম এটা স্বপ্নই হবে নিশ্চয়, আর কী হতে পারে? তাই কাউকে কিছু বললাম না।

পরের রাতেও কিন্তু ঐ দৃশ্য আবার দেখলাম, প্রায় হুবহু আগের রাতেরই মতো। এ রাতে অবশ্য আমি খাওয়া শেষ করার খানিক পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তবে একটা সময়ে কেন জানি না ঘুম ভেঙে গেল। কিছুক্ষণ চোখ মেলে শুয়ে থাকার পর দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দেড়টা বাজে। পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখলাম দরজার পরদার পেছন থেকে, যেন পরদা ভেদ করে, গতকাল রাতের ঐ লোকটি ঘরে ঢুকলো। আগের রাতের মতোই দু-তিন সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে দেওয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে আবারও ডিভানের পেছনের দেওয়ালের গায়ে একই জায়গায় মিলিয়ে গেল, কিংবা কোন অদৃশ্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আজ রাতের এই ঘটনাকে তো স্বপ্ন ভাবতে পারছি না, কারণ আমি জেগেই ছিলাম, তখনও আছি। একটু আগেই ঘড়িতে দেখেছি রাত দেড়টা বাজে আর এখন দেখছি একটা-সাঁইত্রিশ। এই সাত-আট মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখে ফেলিনি নিশ্চয়। তাছাড়া পর পর দু-রাত একই স্বপ্ন?

যে মধ্যবয়স্কা নার্স রোজ সকালে আমার পরিচর্যা, অর্থাৎ বাথরূমে যেতে সাহায্য করা, ওষুধ খাওয়ানো, প্রাতরাশের ট্রে এনে দেওয়া ইত্যাদি, করতে আসেন, তিনি পরদিন আসার পর এক ফাঁকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম:
আচ্ছা, এই হাসপাতালটা কবে তৈরী হয়েছে?
তিনি বললেন, পনেরো বছর আগে। কেন বলুন তো?
এমনিই জানতে চাইছি। আপনি কি সেই থেকেই এখানে রয়েছেন?
না না, আমি আছি বছর পাঁচেক। তবে আমি এই পাড়ারই বাসিন্দা বরাবর, হাসপাতাল আমার চোখের সামনেই তৈরী।
ও। হাসপাতালের আগে কী ছিল এখানে?
অনেক বছরের পুরনো একটা ভাঙাচোরা বাড়ি, তিনতলা। আসলে দু’টো বাড়ি পাশাপাশি, সবাই বলতো জোড়াবাড়ি। বাড়ি দু’টো একটা সরু ব্রিজ দিয়ে জোড়া ছিল। ব্রিজের একটা মাথা ছিল আপনার কেবিনের ঐ দেওয়ালের ওপাশে।
তখন ওখানে একটা দরজা ছিল?
তা তো ছিল নিশ্চয়ই, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাতায়াতের জন্য। আমি অবশ্য ঐ বাড়ি দু’টোর কোনোটাতেই ঢুকিনি কখনো। জন্ম থেকেই দেখে এসেছি দু’টো পোড়ো বাড়ি। তারপর বাড়ি দু’টো ভেঙে ফেলে তাদের জায়গায় হাসপাতালের জন্য একটাই বাড়ি তৈরী করা হয়।
ঐ দুই বাড়িতে কারা থাকতো?

শুনেছি দুই অবাঙালি পরিবার, তারা আত্মীয় ছিল বোধহয়। তাদের অনেকেই ঐ দুই বাড়িতে মারা গেছে, অন্যরাও কি আর বেঁচে আছে এখনও? অনেক বছর ধরেই কোনো বাড়িতেই কেউ থাকতো না।
নার্সের কথা শুনে গত দু-রাতের রহস্যজনক (না কি ‘ভৌতিক’?’) ঘটনার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেলো কি? ঐ জোড়াবাড়ির বাসিন্দারা নিশ্চয়ই ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতো। ঐ দুই বাড়িতে যারা মারা গেছে তাদেরই কেউ একজন কি আমার রাতে দেখা ঐ লোকটি? জীবিত অবস্থায় সে হয়তো প্রায়ই ব্রিজের ওপর দিয়ে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়িতে যেতো-আসতো, হয়তোবা মোটামুটি নির্দিষ্ট সময়ে। মারা যাওয়ার পরেও সে সময় হলেই ব্রিজ পেরিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যায়-আসে। বেচারা জানেই না যে তাদের পুরনো বাড়ি আর নেই, অথচ তার পুরনো অভ্যাসটা এখনও থেকে গেছে। কিন্তু এখন সে ব্রিজ পেরিয়ে কোথায় যায়, পাশের বাড়িটাই যখন আর নেই? আরেকটা প্রশ্ন হলো, ঐ লোকটির এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়ার দৃশ্য আমি কেন দেখতে পেলাম? গত পনেরো বছরে হাসপাতালের ঐ কেবিনে আমার আগে অন্য যে রোগীরা থেকে গেছে তাদের কেউ কি কখনো ঐ লোকটিকে দেখেছে? আমার অভিজ্ঞতার কথা শেষ পর্যন্ত নার্সকে আমি বলিনি, কারণ জানি তিনি, বা অন্য কেউ, বিশ্বাস করবেন না। তাই এই দু’টো প্রশ্নের উত্তরও আমি জানি না।

সেদিন সকালে একটু পরে ডাক্তার এসে আমাকে পরীক্ষা করার পর হাসিমুখে বললেন, বাঃ, আপনি তো সেরেই গেছেন মনে হচ্ছে। দেখি, কাল-পরশু আপনাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া যায় কিনা।
হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার আনন্দেই বোধহয়, সে রাতে আমার চমৎকার ঘুম হলো। এক ঘুমেই রাত কাবার, স্বপ্ন বা অন্য কিছুই দেখলাম না। পর পর দু-রাত দেখা ঐ অচেনা আগন্তুকের চেহারা কিন্তু আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তবে সে যাই হোক, আমার অতীতের দুই অভিজ্ঞতার মতো এই অভিজ্ঞতারও কোন ব্যাখ্যা আজও খুঁজে পাইনি।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199