জীবন জীবনেরই জন্যে

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 21 Oct 2021

1560 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বইটি হাতে নিতেই মনে পড়লো – প্রতিভা বসুর ‘জীবনের জলছবি’। মলাটের পরের পাতাতেই পরিচ্ছন্ন অক্ষরে লেখা, ‘ড: সেলিম জাহান, আমার প্রিয়তম ছাত্র, জীবনকে যে ভালোবাসে’। নীচে স্বাক্ষর ‘মুশাররফ’। কোন এক সন্ধ্যায় আমাদের রুজভেল্ট দ্বীপের বাড়ীর বারান্দায় বইটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক এ পরবর্তী সময়ে সহকর্মী প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন।

মনে পড়লো, খুব সম্ভবত: নব্বুইয়ের মাঝামাঝি সময়ে একবার তিনি নিউইয়র্কে এসেছিলেন। একরাত কাটিয়েছিলেন তিনি আমাদের সঙ্গে আমাদের রুজভেল্ট দ্বীপের বাড়ীতে। বেনু আর আমি দু’জনে ভীষন খুশী। আমাদের দু’জনেরই প্রিয় শিক্ষক, আমি তাঁর সহকর্মীও ছিলাম বহুদিন বিভাগে, পারিবারিক পর্যায়েও হৃদ্যতা বিস্তৃত।

আমাদের কিশোরী কন্যাদ্বয় চমকিত। দেশে তারা সবসময়ে দেখে এসেছে যে তাদের বাবাকেই শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ বলে, কিন্ত তাদের মাতা-পিতারও যে একজন ‘স্যার’ আছেন, যিনি অনায়াসে তাদের ধমকাতে পারেন, এটা দেখেই তারা আহ্লাদে আটখানা। সব মিলিয়ে বিরল এক আনন্দঘন পরিবেশ।

প্রতিদিন বিকেলেই আমরা তিনজন বারান্দায় বসে গল্প করতাম। ঢাকার গল্প, রাজশাহীর স্মৃতি, বেনুর মা-বাবার কথা।আমরা বলতাম তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ইনারী হোসেনের কথা, তাঁদের পুত্রদ্বয় জাফর ও রাজার কথা, সত্তুর-আশির দশকের কথা। সামনের পূর্বী নদীতে নৌকোগুলো চলে যেতো, নদীর পাশ দিয়ে যাতায়াতরত মানুষের কণ্ঠ শোনা যেতো, নদীর ওপারে ম্যানহ্যাটনের আকাশ রেখায় শেষ সূর্য্যের আভা।

তারপর কখন যে সাঁঝের মায়া ঘনিয়ে উঠতো, টেরও পেতাম না। সন্ধ্যা নদীর এপারে এক ধূসর চাদর বিছিয়ে দিত। ছোপ ছোপ আঁধারেরা কালো বেড়ালের মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকতো এখানে-ওখানে। বাতি জ্বলে উঠতো ম্যানহ্যাটনের আকাশ রেখার সুউচ্চ হর্ম্যরাজিতে। পূর্বী নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মৃদু আভাস ভেসে আসতো। চায়ের কাপ হাতে আমরাও উঠে পড়তাম। আসর ভাঙ্গতো। রাতের খাওয়ার আয়োজন শুরু হতো।

এক রাতে, রাতের খাওয়ার পরে তুমুল গল্প হচ্ছিলো। বেনু কথা প্রসঙ্গে একজনের কথা তুললো, যাঁকে স্যারও চেনেন। হঠাৎ বেনুকে থামিয়ে দিয়ে স্যার জিজ্ঞেস করলেন তাঁর অনানুকরনীয় ভঙ্গিতে, ” বাঁইচ্যা আছে তো, না মইরা গ্যাছে’? বিব্রত ও আহত বেনু উত্তর দিলো, ‘ছি, ছি, বেঁচে আছেন, মরে যাবেন কেন’?

উদাস দার্শনিকের ভঙ্গিতে স্যার জবাব দিলেন, “কি কইরা কই, কও? প্রত্যেক দিন ইউনিভার্সিটি এলাকায় বহু লোক দেহি, খায়-দায়, ঘোরে-ফেরে; বাঁইচ্যা আছে না মইরা গেছে, বুঝি তো না’। আমরা সবাই সশব্দে হেসে উঠেছিলাম। পরে বুঝেছি যে স্যারের কথার গভীরতর মর্মার্থ। শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস নিলেই, নশ্বর দেহের অধিকারী হলেই কি আমরা বেঁচে থাকি? দিনগত পাপ-ক্ষয়ই কি জীবন?

যে বেঁচে থাকা শুধু নিজেকে নিয়ে, তাকে কি বেঁচে থাকা বলে? কখনো-সখনো মরে গিয়ে কতো মানুষ বেঁচে যায়, কিন্তু বেঁচে থেকেও কত মানুষ যে মৃত, তার বেলা? যে জীবন নিজেকে ছাড়া অন্যকে ভাবেনি; যে জীবন উদ্ভাসিত করে নি অন্য জীবনকে; যে জীবন শুধু নিয়েছে, কিন্তু কিছু দেয় নি, সেটা কি জীবন?

যে জীবন ভালবাসা নিয়েছে শুধু, কিন্তু ভালবাসা দেয়নি; যে জীবন নিজের সুখে উল্লসিত হয়েছে, কিন্তু ঈর্ষিত হয়েছে অন্যের আনন্দে; যে জীবন নিজের দু:খে কাতর হয়েছে, কিন্তু ব্যথিত হয় নি অন্যের বেদনায়, তাকে জীবন বলি কি করে? নিজের জন্য বাঁচি, কিন্তু অন্যের জন্য বেঁচে থাকি, সেটাইতো জীবন।

যে জীবন তার চারপাশ তাকিয়ে দেখে নি, সে কি জীবন? যে জীবন নীল আকাশের দিকে কখনো চোখ তুলে চায় নি, প্রানভরে ফুলের সুবাস নেয় নি, অঝোর বৃষ্টিতে কখনো ভেজে নি, কি জীবন কাটিয়েছে সে সব জীবন? শিশুর হাসিতে যে জীবনের হৃদয় জুড়োয় নি, সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউয়ে যে জীবন উদ্বেলিত হয় নি, পাখির ডাকে যে জীবন আনমনা হয় নি, সে জীবনে পাওয়া হয় নি বহু কিছু।

অনেক সময়েই আমাদের অগ্রাধিকার নির্বাচনে ভুল হয়, আমরা ‘জীবিকা’ আর ‘জীবনকে’ গুলিয়ে ফেলি, আমরা প্রায়শ:ই জীবিকাকেই জীবন বলে মনে করি। আমরা ভুলে যাই জীবনের জন্য জীবিকা, জীবিকার জন্য জীবন নয়। জীবিকা ভোগের, জীবন উপভোগের।

‘জীবন গড়ছি’ মনে করে আমরা অর্থের পেছনে, বিত্তের পেছনে, নামের পেছনে দৌঁড়ুই। আমার প্রয়াত পিতা বহুকাল আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘অর্থের পেছনো দৌঁড়িও না, অর্থ তোমার পেছনে দৌঁড়ুবে।আমরা ভুলে যাই, অর্থ, বিত্ত ওগুলো জীবন নয়, ওগুলো জীবিকার ফলশ্রুতি। জীবিকা জীবনের জন্যে প্রয়োজন, কিন্তু জীবিকাই জীবন নয়। জীবন জীবিকার চেয়ে অনেক বড়।

অর্থ-বিত্তের জন্যে মানুষকে মনে রাখে না। মানুষ মানুষকে মনে রাখে তার সাহচর্য্যের জন্য, তার দেয়া সময়ের জন্যে, তার মমতার জন্যে। মানুষ মানুষকে মনে রাখে তাঁর সহানুভূতির জন্যে, তাঁর বিবেচনার জন্যে, তাঁর মায়ার জন্যে। চূড়ান্ত বিচারে, মানুষ মানুষকে ভালোবাসুকুই দিতে পারে। মানুষ চলে গেলেও ঐ ভালোবাসাটুকুই থেকে যায় স্মৃতিতে।

আমাদের জীবনে বহু মানুষের কাছ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাপ্তির কথাই আমাদের বেশী মনে থাকে বিশাল কোন কর্ম নয়। আমার মাতামহ চলে যাবার পরে আমার মাতামহী একবার আমাকে বলেছিলেন, তাঁর সব সময় মনে পড়ে, তাঁর স্বামী প্রায়শ:ই তাঁর জন্যে কামরাঙ্গা নিয়ে আসতেন, কারন কামরাঙ্গা তার প্রিয় ফল। আমার মাতামহ তাঁর স্ত্রীর জন্যে কি গহনা বা শাড়ী নিয়ে আসতেন, সেগুলো তাঁর মনে নেই।

আমরা প্রায়শ:ই জীবিকা-জীবনের মধ্যে গুলিয়ে ফেলি। ফলে জীবনের জন্যে করছি বলে আমারা জীবিকার গুরুত্বহীন দিকগুলোর পেছনে ছুটি। কোন দিকে আমরা তাকাই না, জীবিকা ভিন্ন আর কোন বিষয়ে আমরা সময় দেই না। এ বিভ্রান্তির কারনে, আমরা জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নয় তার জন্য, টেরও পাই না কখন প্রিয়জন দূরে সরে গেছে, কখন জীবন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। শুধু পড়ে থাকে আমাদের জীবিকা আর পড়ে থাকি আমরা। মানুষ তখন রিক্ত হয়ে যায়, নি:স্ব হয়ে যায়, জীবনের কিছুই আর তার থাকে না।

একবার এক খ্যাতনামা ব্যক্তির স্ত্রী আমাকে বলেছিলেন যে, মানুষ বিখ্যাত হলে, জগত তাঁদের গ্রাস করে নেয়। তখন তাঁরা আর প্রিয়জনদের থাকেন না। জগত তাঁদের পায়, পরিবারের মানুষেরা তাঁদের আর পায় না। তিনি হয়তো তাঁর জীবনের গল্পই আমাকে শোনাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর কথা শেষ করেছিলেন এই বলে, ‘জীবনে কখনও বিখ্যাত হবেন না’। আমি হেসে ফেলেছিলাম – যেন আমি চাইলেই বিখ্যাত হতে পারি। কিন্তু সে’টা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, খ্যাতির পেছনে আমি কখনো দৌঁড়ুই নি। আমাদের চেয়ে অর্থ ও বিত্তশালী বহু মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, আমাদের পরেও অমন মানুষ আরও অনেক আসবে।

জীবিকা এতো ছোট ক্যানে, এ ক্ষোভ বড্ড বালখিল্য। ‘জীবন এত ছোট ক্যানে’, সে আর্তিটাই বড়। জীবন ছোট বলেই হয়তো বহু কথা কওয়া হয় না, বহু কিছু দেখা হয় না, বহু কাজ করা হয় না -বহু জিনিস অসমাপ্ত থেকে যায়। জীবন একটু বড় হলে জগত, মানুষ ও জীবনের জন্যে সম্ভবত: আরো কিছু করা যেতো। কারন, চূড়ান্ত বিচারে, ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনেরই জন্যে’।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199