চিঠিতে জানাবেন মোহন ভাই

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 1 Jun 2023

7805 বার পড়া হয়েছে

Shoes

মোহন খানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা আরামবাগে সাপ্তাহিক নিপুণ অফিসে কোনো এক গ্রীষ্মকালের দুপুরে। বেশ নিষ্প্রভ আর ঘিঞ্জি অফিস।ছোট একটা টেবিলের ওপাশে বসা মোহন খান। ততোদিনে ‘ভালোবাসা ভালো নেই’ নামে একটা উপন্যাস লিখে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন।অন্য আরেক সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জড়িয়ে গেলাম উজ্জ্বল হাসিমুখের মানুষটার সঙ্গে। অবাক করে দিয়ে আমার সম্পর্কে অনেক তথ্য বলে দিলেন। তারপর দুপুরে কাছেই একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। ব্যাস, মোহন খান মোহন ভাই হয়ে গেলেন।তারপর মোহন ভাই মানেই আড্ডা আর আনন্দ। তার কাছে গোটা পৃথিবীর সমস্যার অন্য নাম ছিলো-নো, প্রবলেম।

সেই আশির দশকের এক দুপুরে হাত ধরেছিলেন মোহন ভাই। আবার এতটা সময় টপকে এসে দুপুরবেলায় হাত ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর ভূগোল থেকে মুছে গেলেন। মৃত্যু পৃথিবীর এক ভয়ংকর ভোজসভা যেখানে প্রতি গ্রাসে জীবনকে খেয়ে ফেলে হাত ধুয়ে উঠে যেতে হয়। মোহন ভাই চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। পেছনে স্মৃতি হিসেবে রেখে গেলেন হাসিমাখা অমলিন এক মুখশ্রী।

একদিন বিকেলে খুব বৃষ্টি পড়ছে। সাপ্তাহিক বিচিত্রার অফিসে রুদ্ধশ্বাস আড্ডা চলছে বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।আছেন, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, প্রয়াত সাংবাদিক মিনার মাহমুদ, মোহন খান আর বিচিত্রার সাহিত্য আর খেলা বিভাগের সম্পাদক আলমগীর রহমান। হঠাৎ মোহন ভাইয়ের মনে হলো, এই বাদলায় সন্ধ্যাবেলা খিচুড়ি খেতে হবে।কোথায় যাওয়া যায়? মোহন ভাই উঠে গিয়ে বিচিত্রার ল্যান্ডফোন থেকে কল দিলেন আলমগীর রহমানের স্ত্রীকে-ভাবী, আমি মোহন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বলে সবাই আমাকে অবহেলা করে। এই শহরে বৃষ্টির সন্ধ্যায় খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু এরা কেউ খাওয়াবে না। আমি কি আপনার কাছে চলে আসবো? ভাবী সঙ্গে সঙ্গে মমতায় গলে গিয়ে আমাদের সবাইকে চলে যেতে বললেন গেণ্ডারিয়ার নিবাসে। অতঃপর সেই বর্ষণক্লান্ত বিকেলে পর্দা ঢাকা রিকশায় চেপে আমরা চললাম গেণ্ডারিয়ায়। মনে পড়ে, সেদিন ভাবীকে বিশ্বাস করানো কঠিন হয়ে গিয়েছিলো মোহন খান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য নন। খিচুড়ি, মাংস আর তরল প্রণোদনার পক্ষপাত তার দিকেই ধাবিত হচ্ছিলো। মোহন ভাই চাপা গলায় বলেছিলেন, ‘মিথ্যেটা থাক। এই সমাদর কোথায় পাবো বলো?

মোহন ভাই মানেই এক ধরণের অনির্ধারিত আনন্দের সংকেত কথাটা ভুল প্রমাণ করা যায়নি কোনোদিন।হঠাৎ হঠাৎ ফোন করে বলতেন, ‘শোন, আজকে আমার জন্মদিন। দুপুরে আমরা একসঙ্গে খাবো;বাসায় চলে এসো।’ প্রথম প্রথম রাজ্যের কাজ ফেলে গিয়ে বোকা হয়েছি।কোথায় জন্মদিন!প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘আরে, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই বললাম।’ পরে মিথ্যাটা টের পেয়েও যেতাম তার কাছে। এমন ভালোবাসার ডাক এই শহরে আর কে ডেকেছিলো?

গালগল্পে ভরা ছিলো মোহন ভাইয়ের পৃথিবী। কিন্তু মোহমুগ্ধ হয়ে থাকতাম তার পাল্লায় পড়ে আমরা। মানুষ জমাতে ভালোবাসতেন মোহন ভাই। একদিন কথাটা বলেওছিলেন-চারপাশে মানুষ ধরে রাখতে ভালো লাগে আমার। মানুষের কাছে থাকো, দেখবে ভালো লাগবে।’ আপনি তো সব ফেলে কতদূরে চলে গেলেন মোহন ভাই! আপনার সঙ্গে এই শহরে কত গল্পের বীজ বাতাসে উড়তেই থাকলো। আমাদের একটা সময় দুপুর পার হয়ে বিকেল, বিকেল টপকে সন্ধ্যায় গড়িয়ে গিয়েছিলো আর কে জানবে?কে দেখা হলে বলবে এই শহরে, ‘ভালো হলো দেখা হয়ে, আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম!

ভালোবাসার জায়গাগুলো আসলে ভীষণ ভঙ্গুর। হাজার যত্নেও গাছ বাঁচে না।কাল গিয়েছিলাম আপনার বাড়িতে। গিয়ে দেখি, বাড়ির দরজায় ফুলের শেষ বিদায় সাজিয়ে রাখা। আপনার অনুপস্থিতির পায়ের কাছে কিছু ফুল রেখে এসেছি আমিও। চিঠিতে জানাবেন কেমন আছেন।  

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199