ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ৩৪

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 10 Nov 2022

2560 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

চোত্রিশ.

মায়ের কথা - ৪

ঘটনা আরও আছে। এতটা নাটকীয় হয়তো নয়, কিন্তু আছে। আগে যেমন লিখেছি, মালবাজারে আমার ছোট ভাইয়ের কাছে থাকার সময় রোজ সকালে মা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটতে বেরোতেন ঘন্টাখানেকের জন্য। একদিন বেরোনোর মুখে তাঁর মনে পড়লো, কে যেন বলেছিলো কাছেই, মাইল পাঁচেকের মধ্যে, যে চা-বাগানটা আছে সেটা নাকি খুবই সুন্দর জায়গা। বাসে এক ঘন্টারও কম পথ। তাহলে তো সেটা দেখতে যেতেই হয়, আজই। সেদিন কী মনে করে মা পুত্রবধুকে ডেকে বললেন, ‘বৌমা, আজ আমার ফিরতে হয়তো একটু দেরী হবে। তোমরা চিন্তা করো না।’ বৌমা তো ভালোই চিনতো মা-কে, শান্তভাবে কেবল প্রশ্ন করলো, ‘আজই ফিরবে তো, মা ?’

হ্যাঁ, হ্যাঁ-এই তো কাছেই যাবো। বিকেলের আগেই ফিরবো।’

যাই হোক, বাস তো মা-কে নামিয়ে দিলো ঐ চা-বাগানের সামনে। বাগানে ঢুকে লাল সুরকি বিছানো পথ ধরে মা এগোতে লাগলেন। বাগানটা সত্যিই খুব সুন্দর, দেখার মতোই। দু-পাশে ঘন সবুজ বেঁটে বেঁটে চা-গাছের সারি, মাঝে মাঝে লম্বা ইউক্যালিপ্টাস্ গাছ, একটু দূরে দূরে পাশাপাশি কয়েকটা করে লাল রঙের টালির চালওলা ছোট ছোট বাড়ি, স্থানীয়রা যেগুলোকে বলে ‘কটেজ’। ফুটচারেক উঁচু শালকাঠের খুঁটির উপরে বসানো কাঠের তক্তার মাচাই বাড়িগুলোর বারান্দা আর মেঝে। তিনচার ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে বারান্দায় উঠতে হয়। বাগানের ‘বাবুদের’ বাসা এগুলো। এমন একটা জায়গা দেখার সুযোগ পেয়ে মা খুবই খুসী। তবে ততক্ষণে সূর্য প্রায় মাথার উপরে উঠে এসেছে, রোদটা বেশ চড়া মনে হচ্ছে, পিপাসাও পেয়েছে। আজ আবার ছোট জলের বোতলটা আনতে ভুলেছেন। হঠাৎ চোখে পড়লো বাগানের ধারে একটা বাড়ির বারান্দায় পাতা টেবিলের এক পাশে বইখাতা নিয়ে বসে একটি কিশোরী, তার উলটো দিকের চেয়ারে একটি তরুণ, বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটির গৃহশিক্ষক। কয়েক পা এগিয়ে মা সিঁড়ি পেরিয়ে বারান্দায় উঠলেন। মেয়েটি আর তার শিক্ষক দুজনেই একটু অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকালো। মা বললেন, ‘খুব তেষ্টা পেয়েছে। জল খাওয়াতে পারবে ?’

তরুণ শিক্ষকটি ছাত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জল নিয়ে এসো তো।’ মেয়েটি দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলে তরুণটি মাকে বললো, ‘আপনি বসুন না।’ তার ছাত্রীর ছেড়ে যাওয়া চেয়ার টেনে বসলেন মা, বললেন, ‘তুমি এখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াও বুঝি?’

‘এই দু-তিনজনকে। আমি আসলে বাগানেই কাজ করি, আর এদের পড়া দেখিয়ে দিই।’

এর মধ্যে বাড়ির ভিতর থেকে বছর পঁচিশ-তিরিশের এক মহিলা বেরিয়ে এলেন হাতে জলের জগ আর একটা গ্লাস নিয়ে, ঐ মেয়েটিরই মা নিশ্চয়। তিনিও মায়ের দিকে একটু বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইলেন, তারপর বললেন, ‘এই নিন, জল খান।’ ততক্ষণে ঐ কিশোরীও বারান্দায় বেরিয়ে এসে তার মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।

আমার মা হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে অনেকটা জল খেয়ে নিয়ে বললেন, ‘আহ্, বাঁচলাম। যা তেষ্টা পেয়েছিলো।’
মায়ের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে মহিলা বললেন, ‘আপনি কোথা থেকে আসছেন, দিদি ? আগে তো দেখিনি এখানে ?’

মা বললেন, ‘দেখবে কী করে, আমি তো থাকি মালবাজারে, আজই প্রথম এখানে এলাম। তোমাকে তুমি করেই বলছি, আমার নিজের মেয়েও তোমার চেয়ে বড়ই হবে বয়সে। শুনেছিলাম তোমাদের এই বাগানটা খুব সুন্দর, তাই দেখতে চলে এলাম।’

‘খুব ভালো করেছেন, দিদি। আসুন, ভেতরে গিয়ে বসবেন চলুন। এই পিংকি, যা তোর পড়া শেষ কর।’
ভেতরের ঘরে বসে পিংকির মায়ের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলেন আমার মা। বললেন, ‘আমার খুব বেড়ানোর শখ, প্রায়ই এদিক-ওদিক ঘুরতে চলে যাই। পশুপতিনাথ দর্শন করেও এসেছি, একাই।’
‘আপনার সাহস আছে, দিদি, এভাবে একা ঘুরে বেড়ান। আমার তো ভয় করবে।’

এই সময় পিংকির টীচার ঘরে ঢুকে ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘পিংকির পড়া হয়ে গেছে, মাসীমা। আমি তাহলে যাচ্ছি আজ।’
‘আচ্ছা, এসো।’

আমার মায়ের দিকে ফিরে ছেলেটি বললো, ‘আপনি মালবাজারে থাকেন বললেন না ?’
‘হ্যাঁ, বাবা। আমার ছেলে বয়েজ্ হাই স্কুলের হেডমাস্টার।’
‘তাই নাকি ? আমি তো চিনি ওঁকে, কয়েকবারই দেখা হয়েছে।‘
‘তোমার বাড়ি কোথায় ?’
‘বহরমপুর চেনেন আপনি ?’
‘চিনি বইকি। আমার ছোট বোন থাকে ওখানে, মাঝে মাঝে যাই তো।’
‘বহরমপুরের গঙ্গার ওপারে আমাদের গ্রাম। খেয়া নৌকায় পারাপার করি আমরা। বহরমপুর কলেজে পড়েছি আমি।’
‘নাম কী তোমাদের গ্রামের ?’
‘গ্রামের নাম আঁখিতারা।’

‘আঁখিতারা? কী সুন্দর নাম! আমি যাবো একবার তোমাদের গ্রাম দেখতে। তোমাদের বাড়িতেও যাবো।’
‘নিশ্চয় যাবেন, দিদিমা,দিদিমা ডাকি আপনাকে? -গঙ্গার ওপারে ঘাটে নেমে যাকেই বলবেন আনোয়ারদের বাড়ি যাবো শেখবাড়ি, সে-ই দেখিয়ে দেবে।’
আনোয়ার চলে যাওয়ার পর পিংকির মা বললেন, ‘একটা কথা বলি, দিদি। এই রোদের মধ্যে বাস ধরে মালবাজার ফিরবেন কেন? আমাদের এখানেই যত্ন করে, দুটো ডালভাত খেয়ে নিন। তারপর একটু বিশ্রাম করে, বিকেলে রোদ পড়লে তখন চলে যাবেন। বাড়িতে চিন্তা করবে না তো?’
‘তা হয়তো করবে না। বলে এসেছি ফিরতে দেরী হতে পারে।’
‘তাহলে আর কী! পিংকির বাবা অবশ্য আজ বাগানে নেই, শিলিগুড়ি গেছে একটা কাজে। সন্ধ্যের আগে হয়তো ফিরবে না। আমিই সময়মতো বাসে তুলে দিয়ে আসবো আপনাকে।’

বছর দেড়-দুই পরের কথা। মায়ের ছোট বোন, আমার ছোট মাসী, বহরমপুরে থাকেন সে’কথা আগেই বলেছি। মা গেছেন বোনের কাছে বেড়াতে। মাসীর বাড়িটা খুব চমৎকার জায়গায়, গঙ্গার তীর ঘেঁষা রাস্তার উপরেই। রোজ সকালবেলায় নদীর পাড়ে পায়ে চলা পথ ধরে বেশ খানিকটা হেঁটে আসেন মা। ঐ পথেই খানিক দূরে ওপারে যাওয়ার খেয়াঘাট। ততদিনে অবশ্য আঁখিতারা গ্রামের কথা প্রায় ভুলেই গেছেন মা। এক সকালে তেমনই হাঁটতে বেরিয়েছেন। খেয়াঘাটের সামনে এসে দেখলেন ওপার থেকে নৌকা আসছে এপারে, এপারের লোকজনও ওপারে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠছে। নিছকই অলস কৌতূহলবশে মা একটা নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওপারে কী গ্রাম আছে?’
‘ওপারের ঘাট থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রামের নাম আঁখিতারা, তাছাড়া আরও আছে....’
আঁখিতারা?! সচকিত হয়ে উঠলেন মা। সেই সুন্দর নামের গ্রামটা, যার কথা বলেছিলো চা-বাগানের সেই ছেলেটি। কী নাম যেন? হ্যাঁ, মনে পড়েছে ,আনোয়ার, শেখবাড়ির ছেলে। বলেছিলো, ‘নিশ্চয় আসবেন আমাদের গ্রামে, দিদিমা।’
আর দ্বিরুক্তি না করে মাঝির হাত ধরে নৌকায় ওঠার জন্য পা বাড়ালেন মা। সাবধানে তাঁকে নৌকায় তুলে মাঝি বললো, ‘পারানি দু-টাকা।’ বটুয়া খুলে মাঝির হাতে দু-টাকা দিয়ে নৌকার পাটাতনে বসে ভাবতে লাগলেন মা: ‘আঁখিতারা। নামটা যেমন সুন্দর, গ্রামের দৃশ্যও নিশ্চয়ই তেমনই সুন্দর।‘
দশ মিনিটেরও কম সময়ে নৌকা ওপারে ভিড়লো। মাঝি তাঁর হাত ধরে নামিয়ে দিয়ে বললো, ‘আঁখিতারার পথ চেনেন? না চিনলে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন, দেখিয়ে দেবে।’
সামান্য উঁচু ঘাটে উঠে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে এক ভাঁড় চা নিলেন মা। সকালে চা খাওয়া হয়নি, এটা দরকার। পাশে বসা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আঁখিতারা গ্রামটা কোন্ দিকে?’
লোকটির চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা হাত দিয়ে ডান দিকটা দেখিয়ে বললো, ‘ঐ তো, ঐ রাস্তা ধরে দশ-পনেরো মিনিট। কাদের বাড়ি যাবেন?’
‘আনোয়ারদের বাড়ি।’
‘শেখবাড়ি? আেেনায়ার তো চা-বাগানে কাজ করে, ডুয়ার্সে। বাড়ি এসেছে চারপাঁচ দিন আগে।’ পাশে রাখা বড়সড় একট পোঁটলা তুলে নিয়ে চলে গেলো সে। মা বসে চায়ের ভাঁড়ে ছোট ছোট চুমুক দিতে লাগলেন।

আনোয়ার গিয়েছিলো বাজারের দিকে। ফেরার পথে চায়ের দোকানের ঐ লোকটি তাকে দেখে বললো, ‘তোদের মেহ্মান এসেছে, আনোয়ার।’
‘মেহ্মান? কে বলো তো?’
‘চিনি না। বয়স্কা মহিলা একজন। ঘাটে বিশুর দোকানে বসে চা খাচ্ছে।’
‘বয়স্কা মহিলা! সে আবার কে?’ আনোয়ার তাড়াতাড়ি ঘাটের দিকে পা বাড়ালো।

চায়ের ভাঁড় শেষ করে মা বেঞ্চ ছেড়ে উঠতে যাচ্ছেন, এমন সময় আনোয়ার এসে সামনে দাঁড়ালো। মাকে চিনতে তার এক মূহুর্তও লাগলো না, ‘দিদিমা! আপনি?! এখানে?’
‘বলেছিলাম না, তোমাদের গ্রাম দেখতে আসবো এক দিন?’ মা হাসিমুখে বললেন। ‘এই দেখো, এসে গিয়েছি।’
‘কী আশ্চর্য! আমার তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। চলুন, চলুন, বাড়ি চলুন। আমার মাকে আপনার কথা বলেছি, যা অবাক হবে না আপনাকে দেখে’
আনোয়াদের বাড়ি পৌঁছাতে পনেরো-কুড়ি মিনিটের বেশি লাগলো না। এটুকু হেঁটে যেতে যেতে মা চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। গ্রামের পথ হলেও তার উপর পিচের আস্তরণ পড়েছে। কাঁচা পথও রয়েছে অবশ্য এদিকে ওদিকে কয়েকটা জায়গায়। প্রচুর গাছপালা, বিস্তৃত সবজির ক্ষেত, পুকুর। সবুজের সমারোহ চারদিকে। ঘরবাড়ির অধিকাংশেরই টিনের বা টালির চাল, ইঁটের দেওয়াল, কয়েকটার দেওয়াল মাটির। প্রায় প্রত্যেকটারই সামনে বা পিছনে বাগান আর অন্যান্য গাছের পাশাপাশি নারকেল গাছও কয়েকটা করে। বেশ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলেই মনে হয়।
বাড়ির সামনে পৌঁছে আনোয়ার চিৎকার করে ডাকলো: ‘মা, ও মা, শিগ্গির এসো, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি ’
বছর পঞ্চাশের একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন ডাক শুনে, ‘কী হলো? কাকে নিয়ে এসেছিস?’ মায়ের দিকে চোখ পড়ায় একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘কে রে ইনি?’
‘দিদিমা। মালবাজারের। তোমাকে বলেছিলাম না এনার কথা? চলে এসেছেন আমাদের গ্রাম দেখতে।’
‘বলিস কী! আসুন দিদি, আসুন ।’
আমার মায়ের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন আনোয়ারের মা। ভিতরে প্রশস্ত, পরিষ্কার নিকোনো উঠান ঘিরে গোটা চারেক ঘর। উঠানের এক ধারে টিউব ওয়েল আর একটা পাতকূয়োর মাঝে একটা ছোট ঘর, বোঝাই যায় স্নানঘর। আরেক পাশে রান্নাঘর। তার গা ঘেঁষে বেশ লম্বা একটা সজনে গাছ, ফুলে ভরে আছে।
রান্নাঘরের দাওয়াতেই মাকে নিয়ে গিয়ে আনোয়ারের মা ডাক দিলেন, ‘ওরে আনোয়ার, একটা মোড়া দিয়ে যা এখানে তোর দিদিমার জন্য।’ নিজে একটা পিঁড়ি পেতে সামনে বসলেন। বললেন, ‘আমার ছেলে বলেছিলো বটে, কিন্তু আমরা ভাবিনি যে আপনি সত্যিই আসবেন। ও হ্যাঁ, আমার নাম ফরিদা।’
‘আমার ছোট বোনের কাছে এসেছি বহরমপুরে,’ মা বললেন। ‘প্রায়ই আসি। আঁখিতারার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজই সকালে গঙ্গার ধারে হাঁটার সময় ঐ নামটা হঠাৎ শুনতে পেলাম আর মনে পড়ে গেলো। চলে এলাম তাই।’
‘খুব ভালো করেছেন। একটু জল খান এখন। আেেনায়ার, দুটো ডাব পেড়ে আন তো দিদিমার জন্য। এক গাল মুড়ি-কদমা খাবেন, দিদি?’
মা সম্মতি জানাতে এক বাটি লালচে রঙের মুড়ি আর দু-তিনটে কদমা তাঁর সামনে রাখলেন ফরিদা। গলা তুলে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ডাব পেড়েছিস? একটার মুখ কেটে নিয়ে আয়। অন্যটা থাক, পরে দেবো দিদিমাকে।’
মা বেশ তৃপ্তি করেই মুড়ি-কদমা চিবোতে লাগলেন। একটু পরে ফরিদা বললেন, ‘দিদি, একটা কথা বলবো? যদি কিছু মনে না করেন ’
‘মনে করবো কেন? বলুন না ’
‘আমার ইচ্ছে, দুপুরে চাট্টি ডালভাত খান আমার বাড়িতে। কিন্তু আমরা তো মুসলমান, আমার হাতের রান্না তো আপনার চলবে না। তাই আপনি নিজেই যদি কষ্ট করে....’
তাঁকে বাধা দিয়ে মা বললেন, ‘অমন কথা বলবেন না। মুসলমান, হিন্দু কোন বাছবিচার নেই আমার। কেন খাবো না আপনার হাতের রান্না? তবে আমি কিন্তু নিরামিষ খাই।’
‘তাই খাবেন, দিদি। ডাল আর ভাত তো আছেই, কী সবজি খেতে পছন্দ করেন বলুন।’
‘একটা সেদ্ধটেদ্ধ কিছু হলেই চলবে। আমি খাই পরিমাণে খুব কমই।’
‘কী খুসী যে হলাম দিদি! যা রান্না হবে তা থেকে যেটুকু ইচ্ছে খাবেন।’
‘আনোয়ারের বাবা বোধ হয় বাড়িতে নেই?’
‘ওটাই তো বিরাট একটা সমস্যা আমার। সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে হয়তো পাঁচ দিনই উনি গ্রামের বাইরে। আমাদের জমির আর গ্রামের অন্য কয়েকজনেরও জমির ফসলের পাইকারী ব্যবসা করেন। আজও গেছেন শহরে, ভোর হতে না হতেই, কখন ফিরবেন কে জানে। ছেলেটাও তো গ্রামে থাকে না, জানেনই তো। দিনের পর দিন একাই কাটাতে হয় আমাকে।’
‘ছেলের বিয়ে দেন না কেন?’
‘দেবো তো বটেই। কিন্তু তাতে আমার কী লাভ হবে? বউকে নিয়ে তো সে কাজের জায়গায় চলে যাবে।’
কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে গেলো অনেক। ফরিদা বললেন, ‘এবার আপনি স্নানটা সেরে নিন, দিদি। নতুন গামছা আছে, দিচ্ছি। তারপর কিছু মুখে দিয়ে একটু বিশ্রাম করুন, বিকেল বিকেল আনোয়ার আপনাকে ওপারে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’
স্নান সেরে এসে ডাল, সজনে ফুল ভাজা আর একটা পাঁচমেশালি তরকারি দিয়ে তৃপ্তি করেই দু-মুঠো ভাত খেলেন মা। ফরিদা একটু দুধ সাধছিলেন, সেটা আর খেলেন না। তারপর ফরিদা তাঁকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে মেঝেতে শীতলপাটি পেতে একটা বালিশ দিয়ে বললেন, ‘চোখ বুজে একটু শুয়ে থাকুন, দিদি। ভালো লাগবে। আমি ছেলেকে খেতে দিই গিয়ে।’
প্রায়ান্ধকার ঘরে শীতলপাটির উপর শুয়ে বেশ আরাম বোধ হচ্ছিলো। ঘুমিয়েও পড়লেন। ঘুম ভাঙলো বোধ হয় ঘন্টাদেড়েক পর। বাইরে এসে দেখলেন রোদের ঝাঁজ অনেকটাই কমে এসেছে। ফরিদা এগিয়ে এসে বললেন, ‘মুখেচোখে জল দিয়ে নিন, দিদি। চা খাবেন তো?’
‘নাঃ, এখন আর চা খাবো না। এবারে যেতে হয়। আমার বোন তো চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে এতক্ষণে।’
‘কেন, বলে আসেননি ওঁকে কোথায় যাচ্ছেন?’
‘তার সুযোগ হলো কোথায়? আমি তো সকালবেলা বেড়াতে বেরিয়ে হঠাৎই চলে এলাম, আাঁখিতারা নামটা কানে আসামাত্র।’
‘দেখো কা-! না না, এখনই বেরিয়ে পড়ুন তাহলে। ওরে আনোয়ার ’
আনোয়ার এগিয়ে এলো, হাতে আর কাঁধে বড়সড় বোঝা, গোটা চারেক ডাব আর একটা পেটমোটা থলে। মা উঁকি দিয়ে দেখলেন থলের ভিতরে রয়েছে বেশ কয়েকটা ঝিঙে, পটল, একটা চালকুমড়ো, পুরুষ্টু এক গোছা শাক, এইসব।
মা আঁৎকে উঠে বললেন, ‘এসব কী?’
‘আমাদের বাড়ির বাগানের সবজি। নিয়ে যাবেন বহরমপুরে বোনের বাড়ি,’ এক গাল হেসে বললো আনোয়ার।
‘পাগল নাকি! কী করে বইবো আমি এই বোঝা?’
‘আপনি বইবেন কেন? আমিই বইবো, বাড়ির দরজা পর্যন্ত।’
ফরিদা হেসে বললেন, ‘এগুলো তো নিতেই হবে, দিদি। ছেলে তো ছাড়বে না।’
‘এবার তো আমাকেই বলতে হয়, দেখো কান্ড!’

ঘাটের পথে যেতে যেতে আনোয়ার বললো, ‘আমি তো সত্যিই ভাবতে পারিনি যে আপনি আমার কথা মনে রাখবেন, আমাদের গ্রাম দেখতে চলে আসবেন। খুব ভালো লাগছে। আমার মা-ও খুব খুসী হয়েছে।’
‘খুব খুসী তো আমিও। যদি না আসতাম তাহলে জীবনে একটা বড় ফাঁক থেকে যেতো। বড় ভালো কাটলো আজকের দিনটা।’

খেয়া নৌকায় গঙ্গা পেরোতে লাগলো মিনিট দশেক। ওপারের ঘাট থেকে বোনের বাড়ি আরও দশ মিনিটের হাঁটা পথ। বাড়ি পৌঁছে দরজার কড়া নাড়লেন মা সামান্য ভয়ে ভয়েই, কারণ বোনের বকুনির মুখে তো পড়তে হবেই নিশ্চয়। দরজা খুলে সামনে মাকে দেখে আমার মাসী তো প্রথম কয়েক মূহুর্ত নির্বাক হয়ে রইলেন, তারপর যেন বেশ চেষ্টা করেই মুখে কথা ফোটাতে পারলেন ,‘দিদি! কোথায় ছিলে সারা দিন? আমার তো দুশ্চিন্তায় পাগল হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। এখন এলে কোথা থেকে?’

মা একবার পিছন ফিরে ডাব হাতে আর থলে কাঁধে আনোয়ারের দিকে তাকালেন। তারপর বোনের মুখের দিকে চেয়ে সংক্ষেপে প্রশান্ত গলায় কেবল বললেন, ‘আঁখিতারা।’
এতেই যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেলো। (আপাতত এ’পর্যন্তই . . . .)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199