ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ২৫

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 18 Aug 2022

2010 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

পঁচিশ.

লন্ডন লাইব্রেরী

আমার কিঞ্চিদধিক তিন দশকের বিলেত প্রবাসের বেশির ভাগটাই কেটেছে লন্ডন শহরে। স্বাভাবিকভাবেই, কারণ এই শহরটিতেই ছিলো আমার কর্মস্থল। একেবারে গোড়া থেকেই, লন্ডনে পদার্পণ করার প্রথম দিন থেকেই বলা যায়, এই শহরটি আমার কাছে একটি অপরিচিত, সুদূর বিদেশী শহর বলে কিন্তু মনে হয়নি। এর কারণ হলো, আমার স্বদেশী শহর কলকাতার সঙ্গে লন্ডনের মিল। আসলে ভারতে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের এক সময়ের রাজধানী কলকাতার একটা বড় অংশকে সাহেবরা গড়ে তুলেছিলো বহুলাংশে লন্ডনের আদলেই। পথঘাট, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, সাজসজ্জা অনেক কিছুই যেন খাস লন্ডন থেকেই তুলে আনা, বিশেষ করে কলকাতার এখনকার যেসব এলাকায় এক সময়ে সাহেবদের বাস ছিলো সেগুলি। ঐ এলাকাগুলির সঙ্গে আমি যথেষ্টই পরিচিত ছিলাম। তাই লন্ডনে পৌঁছানোর পর ঐ শহরের চারপাশ দেখে সেখানে মানিয়ে নিতে আমার যেমন সেভাবে কোন অসুবিধা হয়নি, সময়ও লাগেনি, তেমনি শুনেছি আমার মতো আরো অনেকেরও তা হয়নি বা হয় না। তাছাড়া ইয়োরোপের অন্য কোন দেশে যেমন কথ্য ভাষা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিলেতে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম ইংরেজি ভাষার দৌলতে, যেহেতু এই ভাষাটি আমাদের দেশের দৈনন্দিন শহুরে জীবনে মোটামুটি অভ্যস্ত একটি ভাষা। স্বীকার করতেই হয়, লন্ডনে বসবাস, কাজকর্ম করার অভিজ্ঞতা আমি বা আমরা অবশ্যই উপভোগ করেছি, ঐ শহরটি ছেড়ে চলে আসার পর তার জন্য মাঝেমধ্যে মন খারাপও হয় বৈকি।

ব্যক্তিগতভাবে, আমার কাছে লন্ডনের সবচেড়ে বড় আকর্ষণ হলো এই শহরের লাইব্রেরীগুলি। ছোট-বড়, সরকারী-বেসরকারী লাইব্রেরীর সংখ্যা অগণিত, এবং তাদের বেশির ভাগেরই রীডিং রূম বা পাঠকক্ষ পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত, কলেজ বা ইউনিভার্সিটী লাইব্রেরীগুলিকে বাদ দিলে। প্রত্যেক পৌর এলাকাতেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পরিচালিত লাইব্রেরী আছে এবং সেখানে বইপত্র ছাড়াও আরো বহু ধরনের উপকরণের Ñ যেমন ভিডিও, ডিভিডি বা অডিও ক্যাসেট্ Ñ সমাহার (যত দিন যাচ্ছে ততই অবশ্য এই জাতীয় উপকরণের চেহারা-চরিত্র বদলে গিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রচলন হচ্ছে)। উত্তর লন্ডনে ‘উড গ্রীন’ নামে যে এলাকায় আমরা থাকতাম, সেখানে আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথের দূরত্বেই ছিলো, আজও নিশ্চয় আছে, ‘উড গ্রীন পাবলিক লাইব্রেরী’ বা সরকারী সাধারণ পাঠাগার, আমার অতি প্রিয় একটি পরিষেবা কেন্দ্র। এই পাঠাগার থেকে নিয়মিত বইপত্র ধার করে বা সেখানে বসে অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে কত সময় কাটিয়েছি অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সাথে। ছাত্রছাত্রীদের, উচ্চতর শিক্ষায় বা গবেষণার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অথবা আমার মতো সাধারণ পাঠকদের চাহিদা পুরণের এমন সর্বার্থসাধক, এবং সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক, ব্যবস্থার প্রশংসা করতেই হয় বলা বাহুল্য।

এ তো গেলো স্থানীয় সরকারী পাঠাগারগুলির প্রসঙ্গ। এগুলি ছাড়াও লন্ডন শহরের বড় এবং নামী পাঠাগারগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় ‘ব্রিটিশ লাইব্রেরী’র নাম। ব্রিটিশ লাইব্রেরী এক সময়ে ছিলো ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’এর অংশ, পরবর্তীকালে এটাকে নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত করে সর্বাধুনিক উপকরণ ও সুযোগসুবিধা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ভিতরের পুরানো লাইব্রেরী অবশ্য এখনও আছে এবং তার দৃষ্টিনন্দন গোলাকৃতি পাঠকক্ষে ঢুকলে এখনও দেওয়ালে টাঙানো তালিকায় দেখা যায় এই পাঠাগারের বেশ কয়েকজন নিয়মিত ও সুবিখ্যাত পাঠকের নাম Ñ কার্ল মার্কস্, জর্জ বার্নার্ড শ্য, বারট্রান্ড রাসেল, ডি এইচ লরেন্স, ডাব্লিউ বি ইয়েটস্ এবং আরো অনেকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। লন্ডনে ব্রিটিশ লাইব্রেরীর জুড়ি হলো আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠাগার ‘ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী’।

আমার নিজের কাছে কিন্তু ব্রিটিশ লাইব্রেরী বা ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীর চেয়েও প্রিয় পাঠাগার হলো ‘লন্ডন লাইব্রেরী’। আকারে অবশ্যই অন্য দু’টির তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু অনেক বেশি অন্তরঙ্গ, ‘ইনফর্মাল’। লন্ডন লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন টমাস্ কারলাইল, ১৮৪১ সালে, তারপর ১৮৪৫ সালে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেইন্ট জেমস্’স্ স্কোয়্যার-এ, যখন থেকে সেখানেই রয়েছে এই পাঠাগার। এই পাঠাগারের নিয়মিত পাঠকদের তালিকায় যাঁদের নাম আছে তাঁরাও কম বিখ্যাত নন Ñ প্রতিষ্ঠাতা টমাস্ কারলাইল তো আছেনই, তাঁর সঙ্গে রয়েছেন হেনরী জেমস্ থেকে জর্জ এলিয়ট, চার্লস্ ডিকেনস্ থেকে ভার্জিনিয়া উলফ্। এঁদেরই সমসাময়িক একজন লেখক জন ওয়েলস্, যিনি হাস্যরসাত্মক রচনার জন্য প্রভূত খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন, একবার মন্তব্য করেিেছলন যে লন্ডন লাইব্রেরীর শৌচাগারও একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, কারণ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে প্রায়ই সেখানে যাতায়াত করে থাকেন এইচ জি ওয়েলস্, রাডইয়ার্ড কিপলিং এবং ই এম ফরস্টার-এর মতো ব্যক্তিত্বরা, যদিও হয়তো এক সঙ্গে নয়।

লন্ডন লাইব্রেরীর একটা প্রধান আকর্ষণ হলো তার প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহ। পাঠাগার প্রতিষ্ঠারও বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত বহু বই এখানে সাজানো রয়েছে। আমার মনে আছে, কোন এক শনিবারের দুপুরে একবার প্রায় ঘন্টা তিনেক এই পাঠাগারে পুরানো বই নাড়াচাড়া করে কাটিয়েছিলাম। বেশির ভাগ বইয়েরই মলাট আজকালকার মতো ঝক্ঝকে নয় স্বাভাবিকভাবেই, বাঁধাই তেমন মজবুত নয়, ছাপা হরফগুলি অপরিচ্ছন্ন। কিন্তু তাদের ভিতরের বিষয় এক ধরনের অপার্থিব, সময়াতীত তাৎপর্যে পূর্ণ। এই বইগুলির পাতা ওলটানো যেন টাইম মেশিনে চড়ে অতীতের দুনিয়ায় ভ্রমণ করে আসার অভিজ্ঞতার মতো। সেদিন হঠাৎ চোখে পড়েছিলো অ্যাগনেস্ ডল্টন নামে একজন মহিলার লেখা একটা বই ‘দ্য বুক্ অভ্ সেভেন সীলস্’ (The Book Of Seven Seals), ১৮৭০’এর দশকের পটভূমিতে অনেকটা আত্মজীবনীর ধাঁচে রচিত। বইয়ের এক জায়গায় অ্যাগনেস্ লিখেছেন, এক দিন তিনি আর তাঁর এক বন্ধু লন্ডন লাইব্রেরীতে গিয়েছিলেন ধার করা বই ফেরত দিতে। বাইরে ডিউক স্ট্রীট-এ একদল শ্রমিক খানিকটা জায়গা জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি করছিলো। হঠাৎ তাঁদের চোখে পড়লো খোঁড়া গর্ত থেকে শ্রমিকরা মানুষের বহু পুরানো কঙ্কালের অংশ, পাথরের ও ধাতুর তৈরি গলার মালা, আংটি ইত্যাদি তুলে আনছে। পরে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন যে এগুলি সবই প্রাচীন রোমান সভ্যতার নিদর্শন। হতেই পারে, কারণ এক সময়ে লন্ডন ছিলো রোমান সা¤্রাজ্যেরই অন্তর্গত একটা জনপদ, তখনকার দিনে তার নাম ছিলো ‘লন্ডিনিয়াম’।

ভার্জিনিয়া উলফ্ তাঁর শৈশবে প্রায়ই লন্ডন লাইব্রেরীতে যাতায়াত করতেন। তঁর বাবা একবার লন্ডন লাইব্রেরীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় তাঁদের গোটা পরিবারের মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে গিয়েছিলো। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও ভার্জিনিয়ার এই পাঠাগারে যাতায়াত অব্যাহত ছিলো। সে সময়ে পাঠাগার কর্তৃপক্ষের মধ্যে বুদ্ধিজীবি পুরুষদেরই প্রাধান্য ছিলো। কালক্রমে অবশ্য পরিস্থিতি পালটে গেছে, কিছুদিন আগেও দুই মহিলা ছিলেন লন্ডন লাইব্রেরীর প্রধান পরিচালকদের অন্যতম, পুরুষ আধিপত্য এখন অতীত ইতিহাস।

আমার কাছে কেবল আমার কাছে কেন, নিশ্চয়ই অন্যদের কাছেও  লন্ডন লাইব্রেরীর আরেকটা বড় আকর্ষণ হলো নিজের হাতে বইপত্র বেছে নেওয়ার সুবিধা। ইন্ডিয়া অফিস বা ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে পাঠককে একটা স্লিপে বইয়ের নাম লিখে কাউন্টারে জমা দিয়ে পড়ার এলাকায় বসে অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ না কর্মীদের কেউ এসে বই দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু লন্ডন লাইব্রেরীতে সারি সারি বইয়ের তাকের মধ্যে ঘুরেফিরে, বই হাতে তুলে, কয়েক পৃষ্ঠা উল্টে-পাল্টে দেখে পছন্দ করা যায়। একমাত্র স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের পাবলিক লাইব্রেরীগুলি ছাড়া অন্য কোন বড় পাঠাগারেই এই সুযোগ নেই। প্রতি বছর পাঠাগারের সংগ্রহে নতুন বই যোগ করার নীতি চালু থাকার দরুণ মূল লন্ডন লাইব্রেরীতে আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না, তাই ঠিক পাশের একটা বাড়িতে পাঠাগার এখন সম্প্রসারিত করা হয়েছে এবং সেখানেও যাতে পাঠকরা অবাধে সমস্ত বইপত্র হাতের নাগালে পেতে পারেন তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। লেখকরাও লন্ডন লাইব্রেরীর এই বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণœ রাখায় বিশেষ আগ্রহী, সম্ভবত এই কারণে যে এভাবে তাঁরা পাঠকদের আরো কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেন। এ এস্ বায়াট্ (A S Byatt)-এর লেখা ১৯৯০ সালের ‘ম্যান বুকার’ (Man Booker) পুরষ্কার বিজয়ী উপন্যাস ‘পজেশন’ (Possession)-এর কয়েকটা মূল দৃশ্য তো এই লাইব্যেরীর ভিতরেই সন্নিবেশিত। সোম থেকে শনিবার যে কোন দিন (রবিবার পাঠাগার বন্ধ) লাইব্রেরীর রীডিং রূমে ঢুকলে দেখা যাবে পেশাদার লেখকদের পাশাপাশি বসে শিক্ষাবিদ্ আর ছাত্ররা হয়তো নোটস্ নিতে ব্যস্ত, কিংবা হয়তো বইপত্রের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছেন এমন লোকজন যাঁরা নিছকই পড়–য়া। লন্ডন লাইব্রেরীর আরেকটা সুবিধা হলো যে সদস্যরা এখান থেকে বই ধার করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন পড়ার জন্য, যে সুবিধা ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে নেই। পাঠকদের প্রধানত এই সুবিধা দেওয়াই ছিলো প্রতিষ্ঠাতা টমাস্ কারলাইল-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য। নিজের বাড়িতে নিরিবিলিতে বসে বই পড়তে পারার যে তৃপ্তি সেটা কারলাইল ঠিকই ধরেছিলেন।

ছবিঃ গুগল 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199