ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ৭

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 9 Dec 2021

1670 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেও বেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

সাত.
মার্ক শ্যান্ডের লেখা ‘ক্যুইন অভ্ দ্য এলিফ্যান্টস্’ বইটি দেশবিদেশের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণবিদ্ ও বিশেষজ্ঞদের অবিমিশ্র প্রশংসা অর্জন করেছিলো তো বটেই, সাধারণ পাঠকদের, বিশেষ করে যাঁরা পশুপাখী ও বনজঙ্গলের কাহিনী বা বিবরণ পড়তে পছন্দ করেন তাঁদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। কয়েকটি পুরষ্কারও লাভ করেছিলো বইটি, যাদের একটি ছিলো চৎরী খরঃঃবৎধরৎব ফ’অসরং নামক একটি বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ফরাসী পুরষ্কার। আমি নিজেও এতে একটু-আধটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছিলাম, কারণ পরোক্ষ বা যৎসামান্য হলেও আমার কিঞ্চিৎ অবদান তো ছিলোই।
এর কিছুদিন পরে, মাস তিনেক বা চারেক হবে, মার্ক তাঁর প্রস্তাবিত তথ্যচিত্র নির্মাণের তোড়জোড় শুরু করলেন। প্রযোজকের ভূমিকায় ‘বিবিসি টেলিভিশন’, এবং এ’ক্ষেত্রেও একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটলো। তথ্যচিত্রের জন্য বিবিসি’র নির্বাচিত কলকুশলীদের মধ্যে একজন দেখা গেলো আমার পরিচিত, বন্ধুস্থানীয়ই বলা যায়। রবার্ট (বব) মিল ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত নয়, সে বিবিসি টেলিভিশনের কর্মী, তার কর্মস্থলও অন্যত্র। কিন্তু বুশ হাউজের ক্লাবে তার নিয়মিত আনাগোনা এবং সেখানে সন্ধ্যায় সারা দিনের কাজের পর দু-এক ঘন্টা , কখনো হয়তো আরো বেশী , আমাদের কয়েকজনের আড্ডায় সে প্রায়ই সোৎসাহে যোগ দিতো। বব-ই এক সন্ধ্যায় এসে মার্ক শ্যান্ডের টীমের সঙ্গে তার যুক্ত হওয়ার কথা আমাকে জানিয়ে বললো, ‘তুমি বইটার কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলে শুনলাম, মার্ক নিজেই সে কথা বলছিলেন।’ উত্তরে আমি বললাম, ‘হয়তো এই তথ্যচিত্রেরও চূড়ান্ত পর্যায়ে কিছু কাজ করার সুযোগ আমার হবে।’

দিন পনেরো পরেই বিবিসি টেলিভিশনের দলটিেেক নিয়ে মার্ক শ্যান্ড অসমে রওনা হয়ে গেলেন। যতদূর মনে পড়ে, তখন সেপ্টেম্বার মাসের গোড়ার দিক আর সেখানে তাঁদের কর্মসূচি মোটামুটি মাস তিনেকের মতো। এই সময়টা ঐ অঞ্চলের বনেজঙ্গলে কাজ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, কারণ তখন সেখানকার ভারী বর্ষা ঋতু শেষ হয়ে গেছে আর শীতকাল শুরু হওয়ার আগেই শূটিং এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য ‘আউটডোর’ কাজ স্বচ্ছন্দে সেরে ফেলা সম্ভব। যাই হোক, নভেম্বার মাসের শেষের দিকেই মার্ক ও তাঁর দলবল অসমের কাজ সেরে লন্ডনে ফিরে এলেন। দু-এক দিন পরই আমাকে টেলিফোন করে তাঁদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন, বললেন, ‘কাজ যা হয়েছে তাতে আমি যথেষ্ট সন্তুষ্ট, এবার অন্যান্য টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো গুছিয়ে সেরে নিতে হবে।’ টেকনিক্যাল ব্যাপার বলতে ‘পোস্ট-প্রোডাক্শন’, অর্থাৎ শূটিং-পরবর্তী বিভিন্ন কাজকর্ম, যেমন প্রিন্টিং, এডিটিং বা সম্পাদনা ইত্যাদি। এসব কাজ শেষ হওয়ার পর যা বাকি থাকবে তা হলো ছবির সংলাপের (অসমীয়া বা বাংলা ভাষায়) ইংরেজি ‘সাব-টাইটেল্’ রচনা, যে কাজটা আমিই করবো বলে আগে থেকেই স্থির ছিলো। ছবির অন্য সব কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার পরই এই কাজটা করতে হবে স্ক্রিপ্ট বা চিত্রনাট্যের চূড়ান্ত সংস্করণ অনুসরণ করে। পোস্ট-প্রোডাক্শন কাজ হবে বিবিসি’র ব্রিস্টল স্টুডিওতে।

আরো মাসখানেক বা মাসদেড়েকের মধ্যে ছবি তৈরি হয়ে গেলো। এই সময়ের মধ্যে একটা খুবই মজার ঘটনা ঘটেছিলো। একদিন মার্ক ব্রিস্টল থেকে টেলিফোনে আমাকে বললেন, তাঁর ছবির সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি আমার সঙ্গে জরুরী কথা বলতে চান। এই সম্পাদক (নাম মনে নেই) বললেন যে তিনি হাতি মেরে সাথী নামে একটি সুপার-হিট্ হিন্দী সিনেমার কথা শুনেছেন, যেটাতে নাকি একটি হাতিকে দিয়ে দারুণ (তাঁর ভাষায় ‘ফ্যান্টাস্টিক’) অভিনয় করানো হয়েছে। তাঁর ইচ্ছা ঐ হিন্দী ছবিটি একবার দেখা যাতে মার্কের তথ্যচিত্রের জন্য তোলা কিছু কিছু ‘ফুটেজ’ কীভাবে ব্যবহার করলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হবে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। মার্কের ছবিতেও তো হাতিদেরই মুখ্য ভূমিকা। তাঁর কথা শুনে আমাদের পাড়ার একটা ভারতীয় ভিডিও ক্যাসেটের দোকান থেকে হাথি মেরে সাথী ছবিটির একটা কপি সংগ্রহ করে ডাকযোগে ব্রিস্টলে পাঠিয়ে দিলাম। মার্ক ও তাঁর সম্পাদক ছবিটি দেখা কেমন উপভোগ করেছিলেন বা তার মধ্যে অনুসরণযোগ্য কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা তা ঠিক জানতে পারিনি, তবে দিন দশেক বাদে ছবির ক্যাসেট্ আবার ডাকযোগে আমার কাছে ফেরত এসেছিলো, সঙ্গে একটি চিরকুট যাতে লেখা কেবল দু’টি ইংরেজি শব্দ , ‘ভেরী ফানী!’

এর কিছু দিন বাদে মার্ক আমাকে জানালেন, তাঁর তথ্যচিত্র এখন সাব-টাইটল্ রচনার জন্য তৈরি। ছবির চূড়ান্ত চিত্রনাট্য এবং ভিডিও কপি (সিডি বা ডিভিডি তখন ছিলো না) আমার কাছে এসে পৌঁছালো। এখন আমার কাজ টিভি সেট্-এর সাথে যুক্ত ভিডিও প্লেয়ার-এ ছবি দেখে যেখানে যেখানে অসমীয়া অথবা বাংলা (তুলনায় কমই) সংলাপ আছে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে, সেখানে জায়গামতো উপযুক্ত ইংরেজি বাক্য লেখা। এইভাবে যে জিনিষটা তৈরি হবে তা হলো ‘স্পটিং শীট’, যেটা অনুসরণ করে ফিল্মের উপর সঠিক জায়গায় ঐসব ইংরেজি বাক্য ‘প্রিন্ট’ করে দেওয়া হবে। সেটা করবেন সম্পাদক বা অন্য কেউ বিশেষ একটি যন্ত্রের সাহায্যে। ছবির স্ক্রিপ্ট বা চিত্রনাট্যের প্রতিটা সংলাপ স্পটিং শীট-এ ইংরেজি ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে সাজাতে হবে এবং তাদের ইংরেজি সাব-টাইটল্ও একই ক্রমিক সংখ্যায় সাজানো থাকবে। সুতরাং যে ব্যক্তি ফিল্মের উপর সাব-টাইটল্ প্রিন্ট করবেন, তাঁর কেবল ইংরেজি পড়তে জানলেই চলবে, অসমীয়া, বাংলা বা অন্য কোন ভাষা জানার দরকার হবে না। সময়সাপেক্ষ ও কিছুটা কায়িক পরিশ্রমসাধ্য কাজ তো বটেই, তবে এটা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না কারণ ‘ডিজিট্যাল’ প্রযুক্তির যুগ তখনও শুরু হয়নি। আজকাল এই কাজটা আধুনিক এডিটিং মেশিন-এর সাহায্যে ন্যূনতম পরিশ্রমে খুব সময়েই করে ফেলা যায়।

চলচ্চিত্রের ইংরেজি সাব-টাইটল্ রচনার কাজ আমি সব সময়েই উপভোগ করি, বিলেতে আসার আগে দেশে থাকার সময়েও প্রায়ই এটা করেছি। কলকাতার ফিল্ম স্টুডিওতে অবশ্য সে’সময়ের প্রচলিত এডিটিং মেশিন ব্যবহারের সুযোগ ছিলো, অভিজ্ঞ চিত্রসম্পাদকের সাহায্যও পাওয়া যেতো। এখন লন্ডনে বাড়িতে বসে আমাকে টেলিভিশন আর ভিডিও প্লেয়ার দিয়েই কাজ চালাতে হলো অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই। সেটাও বেশ সময় ও পরিশ্রমসাপেক্ষ, তা সত্ত্বেও কাজ করে যথেষ্ট আনন্দ পেলাম। কাজ শেষ করার পর স্পটিং শীট মার্ক শ্যান্ডের হাতে তুলে দিলাম। চার-পাঁচ দিন পর তিনি টেলিফোন করে বললেন, ‘চমৎকার হয়েছে সাব-টাইটেল্। আমার এডিটার খুব খুশি। বলা বাহুল্য, আমি নিজেও। ধন্যবাদ।’

যথেষ্টই প্রশংসিত হয়েছিলো বিবিসি টেলিভিশন প্রযোজিত এই ক্যুইন অভ্ দ্য এলিফ্যান্টস্ তথ্যচিত্রটি। এখনও এটা দেখতে পাওয়া যায় ইউ টিউব-এ। ডিভিডি-ও পাওয়া যায় সম্ভবত। আমার কাছেও একটা কপি রয়েছে। মার্ক শ্যান্ডের সঙ্গে আর কোন কাজ আমি করিনি, তবে আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা অক্ষুন্ন ছিলো বরাবরই। টেলিফোনে কথা হতো প্রায়শই, বড়দিনের শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করতাম আমরা নিয়মিত। এই সম্পর্কটা বজায় থেকেছে দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের বিলেতবাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছিলো। বছর কয়েক আগে, বোধ হয় ২০১৪ সালে, হঠাৎ শুনলাম মার্ক শ্যান্ড প্রয়াত, অ্যামেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের কাছে এক পথদুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। পুরনো ও প্রিয় বন্ধুবিয়োগের মর্মবেদনা অনুভব করেছিলাম খবরটা জেনে। (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199