ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ১

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 28 Oct 2021

2460 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেও  বেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

এক.

ব্যাক্ টু দ্য ফিউচার নামে আশির দশকের একটি হলিউডি চলচ্চিত্র পাঠকদের কেউ কেউ দেখে থাকতে পারেন। ফ্যান্টাসী (অথবা কল্পবিজ্ঞানধর্মী) এই ছবিটির নায়ক মাইকেল জে ফক্স-এর তার নিজস্ব কাল থেকে অতীত কালে পাড়ি দেওয়ার এবং অতীত থেকে আবার তার নিজস্ব কালে, অর্থাৎ ‘ফিউচার’ বা ভবিষ্যতে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা মজার ঘটনা নিয়ে ছবির কাহিনী সাজানো হয়েছে। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ছবিটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল, একাধিক ংবয়ঁবষ বা অনুবর্তী সংস্করণও নির্মিত হয়েছে এটির।

অতীত থেকে ভবিষ্যতে তো আমরা সকলেই প্রতি নিয়ত প্রতি মূহুর্তে পাড়ি দিচ্ছি সময়প্রবাহ বেয়ে। সময়ের যে বিন্দুটি এই মূহুর্তে বর্তমান, পরের মূহুর্তেই তা অতীত এবং ভবিষ্যৎ সময়বিন্দুটি আবার বর্তমান, আবার অতীত, আবার বর্তমান এইভাবে প্রবহমান অনন্তকাল ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এটাই বাস্তব এবং কল্পকাহিনীর সঙ্গে বাস্তবের তফাৎ হলো যে, অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতে যাওয়া যায় কিন্তু ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে ফিরে আসা যায় না, কারণ সময়প্রবাহ কেবল সামনের দিকেই এগিয়ে চলে, পিছিয়ে যেতে পারে না। বেশ কয়েক বছর আগে একটা ইংরেজি নিবন্ধে একটা খুবই ইন্টারেস্টিং উক্তি পড়েছিলাম, নিবন্ধের বা তার লেখকের নাম এখন আর একেবারেই মনে নেই, কিন্তু উক্তিটি আমার মনে গেঁথে গেছে। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে লেখক বলছেন: The future is very important to me, because that’s where I am going to spend the rest of my life – “ভবিষ্যৎ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানেই আমার অবশিষ্ট জীবন কাটাতে চলেছি আমি।” কথাটা সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য, আমরা প্রত্যেকেই তো আমৃত্যু আমাদের বাকি জীবন কাটাই ভবিষ্যতে, এবং যখন যেখানেই থাকি সেখান থেকে সতত এগিয়ে যাই ভবিষ্যতেই।

একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করি।

আমার জন্ম বর্মার (বর্তমান মায়ানমার) রাজধানী রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গন শহরের এক হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে। এই হাসপাতালে প্রধানত সরকারী কর্মচারীদের ও তাঁদের পরিবারবর্গকে পরিষেবা  দেওয়া হতো এবং আমার বাবা তখন ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারী হিসাব বিভাগের ‘অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল বেঙ্গল’ (সংক্ষেপে ‘এ.জি. বেঙ্গল’) নামের প্রাদেশিক বিভাগটির একজন কর্মকর্তা, ঐ সময়ে রেঙ্গুনের দফ্তরে কর্তব্যরত। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতাই ছিলো ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, তাই কিঞ্চিদধিক সিকি শতাব্দী পরের সময়েও ‘এ.জি. বেঙ্গল’ নামক বিভাগটির প্রশাসনিক গুরুত্ব ছিলো যথেষ্টই।

আমার জন্মের দু-মাসের মাথাতেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের সময়ে যে টালমাটাল অবস্থা সব দেশেই সৃষ্টি হয় বার্মাতেও তেমনই হয়েছিলো, যেমনটা হয়েছিলো ভারতেও। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ তো আমি বিশেষ কিছুই দিতে পারবো না, যুদ্ধ শুরুর সময়ে আমি তো প্রায় সদ্যোজাত শিশু এবং তার পর আরো যে কয়েক বছর আমি মা-বাবার সঙ্গে রেঙ্গুনে ছিলাম তখনও আমার বয়স এতই কম যে কোথায় কী হচ্ছে ভালো করে বোঝাও সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে আর কোন কিছু আমার মনে দাগও কাটতে পারেনি তেমন। তবে কী কারণে জানি না, খুব ছোটবেলার কিছু কিছু ঘটনা কিন্তু আজও আমার মোটামুটি স্পষ্ট মনে আছে, চোখ বুজলেই পুরনো ফোটোগ্রাফের মতো স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। অনেকের ক্ষেত্রেই নাকি এমনটা হয়, শুনেছি। ঐ বয়সে রেঙ্গুনে থাকার সময়ের যেসব ঘটনা ভাসা ভাসা এখনও আমার মনে পড়েতাদের একটা হলো, যে পাড়ায় আমরা থাকতাম, যেটা ছিলো প্রধানত অফিসার শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীদের পাড়া, তার এক প্রান্তে মাটির নিচে ‘এয়ার রেইড শেল্টার’ ,উড়ন্ত যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলার সময়ে আশ্রয় নেওয়ার জন্য  তৈরী করা হয়েছিলো, বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে সেটাতে ঢুকতে আর বেরোতে হতো। এই পাড়ার বাড়িগুলি ছিলো বেশ বড় বড়, তবে সবই একতলা। আরো মনে পড়ে, দিনে বা রাতে বিমানহানার ‘সাইরেন’ বাজলেই সকলকে সব কাজ ফেলে হুড়মুড় করে ছুটে গিয়ে শেল্টারের ভিতরে ঢুকে পড়তে হতো আর ‘অল-ক্লীয়ার সাইরেন’ বা বিমানহানার বিপদ কেটে যাওয়ার সংকেত না বাজা পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করতে হতো। বিপদ যেমনই হোক না কেন, আমার মতো ছোট বাচ্চাদের কাছে এটা ছিলো একটা রোমাঞ্চকর খেলার মতো। এই সময়ের একটা মজার ঘটনার কথা আজও মনে আছে, যেটা আসলে শিশুসুলভ দুষ্টুমির একটা দৃষ্টান্ত। (চলবে) 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199