ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ১১

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 17 Feb 2022

2150 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

এগারো.

কত রকম পুরনো কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। পুরনো বলতে প্রাচীনই বলা যায়, তিন, চার, পাঁচ দশক, এমনকি তারও আগেকার কথা। বেশির ভাগই সুখস্মৃতি, কিছু দুঃখের, যেগুলো আর মনে ধরে রাখতে চাই না। তাদের মধ্যে শৈশবের স্মৃতি যেমন আছে, তেমনই আছে কিশোর বয়সের, যৌবনের, আরো পরিণত বয়সেরও। যেমন ধরা যাক নিচের এই দু’টি ঘটনা, যেগুলি মনে স্থায়ী দাগ রেখে গেছে।

সলিম আলি


আমার কর্মজীবনের একেবারে গোড়ার দিকে, তা প্রায় বছর পঞ্চান্ন আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করার পর কাজ খুঁজছি, অর্থাৎ কিনা জীবিকার সন্ধানে আছি। তখন আমি থাকি মধ্য কলকাতার এন্টালী এলাকায় এক গলির মধ্যে একটি মেসবাড়িতে, নাম ‘প্যারাডাইস লজ’। রোজগারের সূত্র বলতে গোটা তিনেক ছাত্র পড়ানোর কাজ। সামান্য ভুল বললাম, ছাত্র দুজন আর একজন ছাত্রী, যে আবার এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের কিশোরী মেয়ে। ঐ গলিতে এবং পাশাপাশি আরো কয়েকটা রাস্তায় সে’সময়ে বেশ কিছু এই সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবারের বাস ছিলোা। এই মেয়েটিকে পড়ানোর সুবাদে আমার দু-চারজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুও হয়েছিলো। তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ফ্রী স্কুল স্ট্রীট এলাকায় আড্ডাও দিতাম, বড়দিনের ভোজও খেয়েছি কারো কারো বাড়িতে। সে যাই হোক, টিউশনি করে যা পেতাম তা দিয়ে তখন শস্তার দিন বলে কোনমতে চলে যেতো। প্যারাডাইস লজের থাকা-খাওয়ার মাসিক খরচ তেমন বেশি ছিলো না।

একদিন খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো, এলাকারই একটা হাই স্কুলে একজন শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত। আমার নিজেরই বিষয় অর্থনীতির শিক্ষক , স্নাতক অথবা  স্নাতকোত্তর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিকট হইতে স্বহস্তে লিখিত দরখাস্ত আহ্বান করা হইতেছে।’ ঐ সময়টাতে অনেক চাকরির ক্ষেত্রেই দেখতাম ‘স্বহস্তে লিখিত দরখাস্ত’ চাওয়া হচ্ছে, কারণটা ঠিক জানি না। তবে তা নিয়ে আমার তেমন দুশ্চিন্তা ছিলো না কারণ বন্ধুবান্ধব সবাই বলতো আমার হাতের লেখা নাকি ভালো (তখন হয়তো তাই ছিলো, তবে এখন!!)। ভেবেচিন্তে দরখাস্ত লিখে বিজ্ঞাপনে দেওয়া ঠিকানায় ডাকে পাঠিয়ে দিলাম। দিন দশেক পরে ডাকেই উত্তর এলো ‘অমুক’ দিন বেলা এগারোটায় সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জানিয়ে। স্কুলের নাম ‘বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠ’। খোঁজ নিয়ে জানলাম কলকাতার ঐ অঞ্চলের একটি প্রাচীন বাংলা স্কুল, সবাই চেনে, আমার মেসবাড়ি থেকে বড় জোর মিনিট বিশেক হাঁটাপথের দূরত্বে। নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে স্কুলে পৌঁছে প্রধান শিক্ষক এবং আরো জনা চারেক প্রবীণ শিক্ষকের সামনে সাক্ষাৎকারে হাজিরা দিলাম। তারপর পনেরো-কুড়ি মিনিটের বাঁধাধরা প্রশ্নোত্তর পর্ব, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশংসাপত্র পরীক্ষা ইত্যাদির পর প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘আমাদের ইচ্ছা এক সপ্তাহের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা। ঐ সময়ের পর পরই আপনি কি যোগ দিতে পারবেন?’ আমি হেসে বললাম, ‘আপনারা চাইলে আগামী কাল থেকেই পারবো।’ প্রবীণ শিক্ষকদের সামনে আমার মতো একজন সদ্য যুবার এমন উক্তি কিঞ্চিৎ প্রগলভতা হয়েছিলো হয়তো তবে ধৃষ্টতা সম্ভবত হয়নি কারণ এক সপ্তাহ পরেই নিয়োগপত্র ডাকযোগে মেসবাড়ির ঠিকানায় আমার নামে এসে পৌঁছেছিলো।

বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠে মোটামুটি তিন বছরের মতো শিক্ষকতা করেছিলাম আমি। ঐ ক’বছরের ভালোমন্দ মিশিয়ে সমস্ত অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে প্রচুর সময় ও পরিসর দরকার, তাই সেদিকে যাচ্ছি না। যাই হোক, স্কুলে যোগ দেওয়ার মাস চারেক পর প্যারাডাইস লজ ছেড়ে শিয়ালদা এলাকায় বৈঠকখানা রোডের কাছে অন্য আরেকটা মেসবাড়িতে আস্তানা নিয়েছি, যেখানে আমার দু-তিনজন পুরনো বন্ধু ছিলো বোর্ডার। সেখান থেকে বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠ তুলনায় আরেকটু লম্বা দূরত্বে অবস্থিত হলেও হেঁটেই স্কুলে যাতায়াত করা সম্ভব ছিলো। এই মেসবাড়িতেই কাটিয়েছি দু-তিন বছর, আনন্দেই বলা যায়। এখানে থাকতে থাকতেই স্কুল ছেড়ে কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেছি, একটি সুপরিচিত পুরনো কলেজের দক্ষিণ কলকাতা শাখায়, তার পর কেটে গেছে বারোচৌদ্দ বছর। ততদিনে আমার মেসবাড়িতে থাকার পালা সাঙ্গ হয়েছে, উত্তর কলকাতার প্রাচীন এলাকা বেলগাছিয়ায় একটি ভাড়াবাড়ির তিনতলায় একটি দু-কামরার ছোট ছিমছাম ফ্ল্যাটে উঠে এসেছি। যে গলিতে এই বাড়িটি তার সামনের বড় রাস্তা পেরোলেই উলটো দিকে ট্রাম ডিপো, তাই যাতায়াতেরও খুব সুবিধা। তখনকার কলকাতায় ট্রাম ছিলো অত্যন্ত সুবিধাজনক ও আরামদায়ক একটি জনপরিবহন ব্যবস্থা, আমিও বেশির ভাগ গন্তব্যের জন্য ট্রামই পছন্দ করতাম। পরিতাপের বিষয়, অল্প সংখ্যক ট্রাম এখনও চলে বটে কিন্তু তা আজকাল হয়ে দাঁড়িয়েছে অবহেলিত ও অপাংক্তেয়। ঐ সময়ে একদিন সন্ধ্যার মুখে আমি এবং পুরনো স্কুলের এক সহকর্মী বীরেন-দা (যাঁর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো আশি’র দশকের মাঝামাঝি আমি বিলেতে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত) কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। হঠাৎ একটা চারচাকা গাড়ি পাশ দিয়ে যেতে যেতে ঘ্যাঁচ্ করে একেবারে আমাদের গা ঘেঁষে ব্রেক্ কষলো। আমরা সামান্য চমকে সেদিকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সুবেশ স্মার্ট যুবক গাড়ির দরজা খুলে নেমে এসে ভরসন্ধ্যার ঐ ভীড়ের মধ্যেই আমাদের দুজনের পায়ে ঢিপ্ ঢিপ্ করে প্রণাম করলো। আমরা তো অবাক।
যুবকটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমাকে চিনলেন না তো, স্যার?’
আমরা মাথা নাড়তে সে বললো, ‘আমি কিন্তু আপনাদের দেখেই চিনতে পেরেছি। আপনাদের ছাত্র ছিলাম বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠে।’
আমরা খুশি হয়েই বললাম, ‘তাই নাকি? তা কী খবর তোমার? কী করো এখন?’
‘ছোটোখাটো ব্যবসা, স্যার। দাঁড়িয়ে গেছে আপনাদের আশীর্বাদে।’
আরো দু-চারটে কথা বলার পর বিদায় নেওয়ার আগে যুবকটি আবার আমাদের প্রণাম করে হাসিমুখে বললো, ‘আপনাদের জন্যই জীবনে করে খাচ্ছি। আমাকে মনে রাখবেন।’
গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো ছেলেটি। বীরেন-দা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইটুকুই যথেষ্ট। আর কোন প্রাপ্তির দরকার নেই আমাদের, কী বলো?’
মুখে কিছু না বলে আমি কেবল মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

আরো সাত-আট বছর পরের কথা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট পক্ষীবিশারদ, ‘বার্ডম্যান অভ্ ইন্ডিয়া’ আখ্যায় ভূষিত সলিম (মইজুদ্দিন আবদুল) আলির সঙ্গে জড়িত একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সবিনয় অবতারণা।
সলিম আলির আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অভ্ আ স্প্যারো’ (The Fall Of A Sparrow) প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৫ সালে, যখন তাঁর বয়স প্রায় ৮৯ (২০২১ সালের নভেম্বার মাসে তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী)। ঐ সময়ে ‘অ্যরনিথলজী সোসাইটী অভ্ ইন্ডিয়া’র (Ornithology Society of India) উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন বয়সজনিত বাধাকে উপেক্ষা করে। তখন একটি অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিকের তরফে সলিম আলির একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আমাকে গ্র্যান্ড হোটেলে পাঠানো হয়েছিলো। প্রায় দু’ঘন্টার একটি অতি উপভোগ্য সময় কাটিয়েছিলাম তাঁর সান্নিধ্যে।

পরদিন কাগজের দফ্তরে যাওয়ার একটু পরেই আমার ডাক পড়লো বিভাগীয় সম্পাদকের ঘরে। আমি যেতেই সম্পাদক সহাস্যে বললেন: গতকাল আপনি তো দারুণ কাজ করেছেন। সন্ধ্যায় আমাকে ফোন করে সলিম আলি আপনার খুবই প্রশংসা করলেন। বললেন: ‘দ্য ইয়াং ম্যান ইউ সেন্ট ওভার টু টক্ টু মি ও্যয়জ্ সাচ্ আ গুড কনভারসেশনালিস্ট। অ্যান্ড আই ও্যয়জ্ মাচ্ ইমপ্রেসড্ বাই দ্য ইন্টারেস্ট হি ডিস্প্লেড ইন মাই ওয়ার্ক।’ সম্পাদকের কথা শুনে আমি তো যারপরনাই অবাক। যে ঘন্টাদুই সলিম আলির সঙ্গে ছিলাম, আমি চার-পাঁচটার বেশি বাক্য উচ্চারণ করিনি। তিনিই বলে গেছেন তাঁর কাজের, পক্ষীপ্রেমের আর অভিজ্ঞতার কথা এবং আমি মুগ্ধ হয়ে কেবল শুনেছি আর নীরবে নোটস্ নিয়েছি। তাহলে আমি “সাচ্ আ গুড কনভারসেশনালিস্ট” হলাম কী করে? আসলে আমার মুগ্ধতার, আন্তরিক আগ্রহের অভিব্যক্তি নিশ্চয়ই আমার চোখেমুখে ফুটে উঠেছিলো আর সেটাই সলিম আলির অন্তরকে স্পর্শ করেছিলো। তাই আমি মুখ বিশেষ না খুললেও তাঁর মনে হয়েছিলো আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কথোপকথনে অংশ নিচ্ছিলাম।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199