মানুষ ডাহুকও বটে

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 16 Dec 2023

2100 বার পড়া হয়েছে

Shoes

রুজভেল্ট দ্বীপের প্রধান রাস্তাতেই দেখা বন্ধুটির সঙ্গে – রাস্তার এপারে ওপারে। বহুদিন ধরে দ্বীপটির বাসিন্দা দু’জনেই।রাস্তার ওপার থেকেই চেঁচিয়ে ডাকলো সে ‘ওহে, কোথায় যাচ্ছো এ সাত-সকালে?’ বন্ধুটির ‘ওহে’ সম্বোধন ভারী ভালো লেগেছিলো আমার – কতদিন পরে হারিয়ে যাওয়া শব্দটি শুনলাম। তবে তার আগে কোন দিন আমি তাকে ‘কে হে’ বলেছিলাম। লোপামুদ্রার ‘তোমরা কে হে’ গানের কল্যানে ‘কে হে’ মাঝে মধ্যে শুনতে পাই, কিন্তু ‘ওহে’ শুনিনি কত যুগ। আর কৌলীন্যে বোধহয় ‘কে হে’ র চাইতে ‘ওহে’ শ্রেয়তর।

সারা জীবনে কত যে সম্বোধনের মুখোমুখি হয়েছি, কত নামে যে মানুষ ডেকেছে – শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে এবং এখনও। শৈশবে আমার নানা ডাকতেন ‘হুজুরে আলা’ বলে – বেশ খানদানী সুরে। বড় ফুপু ডাকতেন ‘বাপ’ বলে, কইতেন, ‘আমার বাপ নেই, তোকেই বাপ ডাকি’। বাবার বন্ধু এবং সহকর্মী বি.এম. কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম মজুমদার আমাকে ‘ফাদার’ বলে সম্বোধন করতেন। ভারী গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো নিজেকে।

কৈশোরে বরিশাল জিলা স্কুলে নরেন পন্ডিত মশায় আমাদের ‘ওহে বালক’ বলে সম্বোধন করতেন। মা’র বাক্স থেকে চুরি করা শরৎচন্দ্রের বইয়ে ‘ওহে’ র ছড়াছড়ি ছিলো। ‘বিপ্রদাস’ এ দেখেছি, বেশ মনে আছে। ‘দত্তা’তেও কি ‘ওহে বিলেস’ বলে রাসবিহারী হাঁক দেন নি? বছরের প্রথমে হারান বাবুর বইয়ের দোকান থেকে নতুন শ্রেনীর নতুন বই কিনে তার গন্ধ শুঁকতে গেলে হারান কাকা বলতেন, ‘ওহে, ওটা করো না, ছাপাতে সিসে থাকে’। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সতীর্থ বন্ধু মোফাজ্জল ‘গুরুদেব’ বলে ডাকতো আমায়। তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে ঢাকা বেতারে ‘হিং টিং ছট’ বলে দু’চরিত্র বিশিষ্ট একটি রম্য অনুষ্ঠান হতো – যার একটি চরিত্র ছিলো ‘গুরুদেব’, যেখান থেকে ঐ ডাকের জন্ম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে সম্বোধনের পুস্প পল্লবিত হয়ে উঠলো – ছাত্রবাসে, বিভাগে, বিভাগের বাইরে। সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাসে ৩৩ নম্বর সহকক্ষবাসী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সেলিম শাহাবুদ্দীন আমাকে সম্বোধন করতো ‘লোকটা’ বলে, কারন তার কিছুকাল আগে শিশুতোষ পত্রিকা ‘টাপুর টুপুরে’ আমার একটি ছড়া বেরিয়েছিলো, যার প্রথম লাইনটি ছিলো ‘লোকটা নাকি গাধার মতো’।

অন্য সহকক্ষবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মন্টু ডাকতো ‘কমরেড’ বলে, কারন তখন সে ভীষনভাবে বামপন্থী রাজনীতি করতো। একবার আমি তাকে ‘বেশীরেড’ বলাতে বড়ই আহত হয়েছিলো সে। ছাত্রাবাসের মাঠে একদিন প্রদর্শিত ‘অপুর সংসার’ দেখার পরে পাশের ঘরের ইতিহাস বিভাগের সতীর্থ সিরাজ আমাকে ‘অপূর্ব বাবু’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছিলো। কবুল করি, পুলকিত হয়েছিলাম সৌমিত্রের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে ভেবে। ‘বয়সটাই যে খারাপ’।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ কামাল এমন একটা নামে ডাকতো তার স্থাপিত একটি সম্পর্কের ভিত্তিতে – বেনুকে তার বোন ধরে নিয়ে। তবে সেই সম্পর্ক আর তার ডাক নিয়ে সে গুবলেট করে ফেলেছিলো। কিন্তু স্বীকার যেতো না কিছুতেই। খুকু ডাকতো ‘ফার্স্ট বয়’ বলে সন্মান পরীক্ষার ফল বেরুবার পরে। ঠাট্টা করে বলতাম, ‘অন্তত: একবার ‘ফার্স্ট ম্যান’ তো বলতে পারো’। হাসতো সে। আমার সতীর্থ ছিলো দু’জনেই।

বিভাগীয় শিক্ষক যখন হলাম, তখন ‘স্যার’ হয়ে গেলাম বেশীর ভাগের কাছে। ‘ভাই’ রয়ে গেলাম কাছাকাছি অনুজ শিক্ষার্থীদের কাছে। তবে আমার স্যার অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন উল্টো আমাকেই স্যার সম্বোধন করতেন। ‘কি স্যার, শরীলডা ভালা তো? মনডা?’ – এ ডাক এখনো শুনতে পাই। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সম্বোধন করতেন ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলে। মাহবুব ভাই (প্রয়াত ড: মাহবুব হোসেন) আমার পুরো নাম ধরে ডাকতেন, কখনও শুধু প্রথম নাম ধরে ডাকেন নি।

পেশাগত জীবনে আনুষ্ঠানিক ডাক ‘ড: জাহান’ বা ‘প্রফেসর জাহান’ – সেটাই ছিলো প্রচলিত। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরে ড: মাহবুবুল হক আমাকে সম্বোধন করতেন, ‘সবচেয়ে সুবেশ ভদ্রলোক’ বলে, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ডাকেন, ‘মানব উন্নয়নের হৃদয়’ বলে। জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, ড: মাহবুবুল হককে তিনি বলেন, ‘মানব উন্নয়নের মস্তিষ্ক’ আর নিজেকে বলেন, ‘মানব উন্নয়নের বিবেক’। স্যার রিচার্ড জলি আমাকে ডাকেন, ‘মানব উন্নয়নের উচ্চ পাদ্রী’ বলে।

আর এখন সার্বজনীন ভাবে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধিত হই। সারা জীবন ঐ সম্বোধনটি আমার পিতার জন্যেই বরাদ্দ ভেবেছি। এখন মনে হয়, আমি বোধহয় জীবনরশির ওই বিন্দুতে পৌঁছেছি, যেখানে লোকে ঐ নামেই আমাকে ডাকবে। কিন্তু ভাবি, সত্যিকারের ‘স্যার’ ছিলেন আমার পিতা, আমি তো এক ‘অসার স্যার’। তবু বুঝতে পারি, ঐ ডাকের মধ্যে মানুষের শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম আর ভালোবাসা মেশানো থাকে।

সারা জীবন এই যে এতো সম্বোধনে সম্বোধিত হয়েছি, তা ভাগ্য বলে মানি। নমিত হই এ সমৃদ্ধির কাছে। নানান সময়ের নানান ডাক হৃদয়ে ধরে রাখি, স্মৃতিতে জমা করি – কারন কোন কোন ডাক তো আর কখনও শুনতে পাবো না এ জীবনে।

আসলে সম্বোধন তো শুধু নিছক ডাক নয়, একজন মানুষকে অন্য আরেক জনের কাছ থেকে পৃথক করার মামুলী কলকব্জাও নয়। ডাকের পেছনে মমতা থাকে, মায়া থাকে, স্মৃতি থাকে, ইতিহাস থাকে। ডাকেরও কথা থাকে, ডাকও কথা কয়। সে কারনে মানুষ ‘ডাহুক’ও বটে।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199