ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ৬

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 2 Dec 2021

2090 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেও বেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

ছয়

প্রমথেশ চন্দ্র বরুয়া

মার্ক শ্যান্ডের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ দিয়েছি। তাঁরই মুখের কথায় সওয়ার হয়ে কীভাবে প্রায় ভুলে যাওয়া কয়েক যুগ আগের আমার শৈশবের দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছিলাম তারও উল্লেখ করেছি সেখানে। তবে আমার এই আশ্চর্য ভ্রমণের অনুঘটক ছিলেন এই যে ব্যক্তি, প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে তাঁর কিছুটা বিস্তারিত পরিচয় দেওয়া দরকার।
এক সন্ধ্যায় একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে টেলিফোনে নাতিদীর্ঘ কথোপকথনের জের ধরে আমার জীবনে যে নাটকীয় অভিজ্ঞতার সূত্রপাত, তার মধ্যমণি মার্ক শ্যান্ড। যেমন বলছি, এর আগে তাঁকে আমি চিনতাম না, তাঁর নামও আমার শোনা ছিলো না, যদিও তাঁর পেশা বা কাজকর্মের ক্ষেত্রে তিনি একজন স্বীকৃত, স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যেটা আমি পরে ক্রমে ক্রমে জেনেছি। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে তিনি ছিলেন সেই শ্রেণীর একজন যাকে ব্রিটেনে বলা হয় ‘আপার ক্লাস’, সমাজের ওপর তলার লোকজন। দু-এক দিনের মধ্যে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম যে মার্ক শ্যান্ড Ñ পুরো নাম মার্ক রোল্যান্ড শ্যান্ড Ñ একজন বিশিষ্ট ‘ন্যাচারালিস্ট’ বা প্রকৃতিবিদ্ ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ এবং সুপরিচিত লেখকও। ব্রিটেনের যুবরাজ চার্লস্-এর প্রথম যৌবনের বান্ধবী ক্যামিলা পার্কার বৌলস্-এর ভ্রাতা। (সবাই জানেন, ১৯৯৭ সালে চার্লস্-এর পতœী প্রিন্সেস্ ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যুর কয়েক বছর পর, ২০০৫ সালে, চার্লস্ পুরনো প্রেমিকাকে বিবাহ করেন। সুতরাং তখন থেকে মার্ক শ্যান্ড যুবরাজ চার্লস্-এর শ্যালক।) ব্রিটেনের এই তথাকথিত ‘আপার ক্লাস’এর অবস্থান আমজনতার ধরাছোঁয়ার বেশ খানিকটা বাইরেই এবং এই সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিক ও চরিত্রগত ভাবেই কিছুটা উন্নাসিকও। এঁদের কারো ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসতে পারা সে দেশের সাধারণ মানুষের অনেকের কাছেই বিশেষ পরিতোষের বিষয়। অবশ্য কেবল ব্রিটেন নয়, দুনিয়ার সমস্ত দেশেই এঁরা আছেন, ‘সুপার রিচ’ বা কোন না কোন কারণে বিশেষ মর্যাদাভোগী শ্রেণীর পরিচয়ে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়।

সে যাই হোক, মার্ক শ্যান্ডের সঙ্গে আমার পরিচয়ের গোড়া থেকেই তাঁর মধ্যে এই অভিজাত শ্রেণীসুলভ উন্নাসিকতা বা আমজনতাকে এড়িয়ে চলার কোন প্রবণতা কিন্তু আমার নজরে পড়েনি কথাবার্তায় বা কাজের ক্ষেত্রে। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি যে সহজ ও আন্তরিক আচরণের দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন, বরাবরই সেটাই বজায় রেখে গেছেন। তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ঐ সন্ধ্যায় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিলো, তিনিও একই রকম সহজ, স্বাভাবিক ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর বর্তমান যে গবেষণামূলক প্রকল্পটির ব্যাপারে মার্ক আমার সহায়তা চাইছিলেন তা বিশদে ব্যাখ্যা করলেন তিনি। আগেই যেমন বলেছি, প্রকৃতীশ চন্দ্র বরুয়া এবং তাঁর কন্যাকে নিয়ে বই লেখার কাজ হাতে নিয়েছেন। প্রকৃতীশ অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে প্রয়াত, চল্লিশোর্ধ্ব পার্বতীর নিবাস এখন গৌরীপুরে নয়, গুয়াহাটিতে। তাঁর এই গবেষণা ও বই লেখার কাজে মার্ক কয়েক বছর ধরেই প্রচুর পরিশ্রম করছেন। নিজের মনোনীত বিষয়টিতে তাঁর উৎসাহের প্রধান কারণ হাতিদের, বিশেষ করে এশিয়ান হাতিদের, প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও এই প্রাণীটির সংরক্ষণে তাঁর আগ্রহ। সেজন্যই দুই বিশিষ্ট ও অভিজ্ঞ হস্তিবিশারদ হিসাবে তিনি প্রকৃতীশ ও তাঁর কন্যাকে বেছে নিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘পিতা-পুত্রী দুজনেরই হাতিদের প্রতি ভালোবাসা, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং এই চমৎকার প্রাণীটির সংরক্ষণে তাঁদের ঐকান্তিক প্রয়াস অতুলনীয়। আমার গবেষণার জন্য এঁদের চেয়ে যোগ্য সাবজেক্ট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পরিতাপের বিষয়, প্রকৃতীশ এখন ইহজগতে নেই, কিন্তু পার্বতীর সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট।’

মার্ক তার গবেষণাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্বে যে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তার বিবরণ শুনে আমি চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হওয়ার কয়েক বছর আগেই তিনি অসমে গিয়েছিলেন পার্বতী বরুয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মুখোমুখি কথা বলার জন্য। দু’জনে মিলে আলোচনা করে কাজকর্মের একটা রূপরেখা তৈরী করেন। তারপর মার্ক একটা হাতি কিনে ফেলেন, হাতিটিকে ভালোভাবে চেনার ও তার বিশ্বাস অর্জনের জন্য এবং হাতির পিঠে চড়ে তাকে চালনা করার জন্য পার্বতীর সুপারিশ অনুসারে একজন মাহুতকে নিয়োগ করে তার কাছ থেকে প্রায় ছয় মাস ধরে প্রশিক্ষণ নেন। ঐ হাতিটির নাম ছিলো ‘তারা’। এর পরেই তিনি তারার পিঠে সওয়ার হয়ে নানা জায়গায়, বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ান, অনেক সময়েই পার্বতীও তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। এইসব কিছুর ফাঁকে ফাঁকে তিনি পার্বতী এবং হাতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অন্যান্য লোকজনের সাহায্যে তাঁর গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথিপত্র সংগ্রহের কাজ করতে থাকেন। এইভাবে কেটে যায় প্রায় তিনটি বছর, তার পর যখন তাঁর মনে হয় যে গবেষণার প্রস্তুতিপর্ব সুসম্পন্ন, তখন মার্ক ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে, যেখানে বসে তিনি তাঁর কাজের চূড়ান্ত রূপদান করবেন। ফিরে আসার আগে মার্ক যে কাজটি করলেন তা হলো, যে মাহুতের কাছ থেকে তিনি তারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব স্থাপন করতে এবং তার পিঠে সওয়ার হয়ে ইচ্ছামতো ঘোরাফেরা করতে শিখেছেন, তার হাতেই তারাকে তুলে দেওয়া উপহার হিসাবে, কতকটা যেন গুরুদক্ষিণা দেওয়ার মতো। তাঁর এই উদারতার নিদর্শনে পার্বতী বরুয়াও খুশি হয়েছিলেন।

যেসব নথিপত্র মার্ক অসম থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলো কয়েকটা বই এবং বিভিন্ন স্থানীয় সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সবই হাতি এবং হাতিদের নিয়ে কাজ করেন বা করেছেন এমন লোকজন সম্পর্কে। অসম ও উত্তর বঙ্গের যেসব বনাঞ্চল হাতিদের বিচরণক্ষেত্র তাদের বর্ণনা, বুনো হাতি ধরার এবং তাদের পোষ মানানোর ও তাদের দিয়ে নানা ধরনের কাজ করানোর কলাকৌশলের বিবরণ। এইসব নথির অনেকগুলিরই বিষয় প্রকৃতীশ চন্দ্র এবং হাতিদের নিয়ে তাঁর জীবনযাপন, সেই সঙ্গে পার্বতী বরুয়ার সম্পর্কেও অনেক কথা ও কাহিনী। প্রধানত এগুলিই মন দিয়ে পড়ে তাদের বিশেষ বিশেষ অংশ নির্বাচন করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেওয়াই হবে আমার কাজ। বই ও অন্যান্য নথির অধিকাংশই অসমীয়া ভাষায় লেখা। তাতে অবশ্য আমার তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারণ শৈশবের অনেকটা সময় গৌরীপুরে কাটানোর ও কয়েক বছর সেখানকার হাই স্কুলের ছাত্র থাকার সুবাদে অসমীয়া পড়তে ও লিখতে আমি মোটামুটি অভ্যস্ত ছিলাম। এটা জেনে মার্ক শ্যান্ড যাপরনাই উল্লসিত হলেন। একটা বই ছিলো বাংলায় লেখা, সেটা প্রধানত প্রকৃতীশ চন্দ্র বরুয়ার জীবনবৃত্তান্ত। সব মিলিয়ে আমার কাজ যথেষ্ট সময় ও ধৈর্যসাপেক্ষ হলেও আমার সামর্থ্যের মধ্যেই। সুতরাং মার্ক শ্যান্ডকে তাঁর গবেষণা ও বই লেখার কাজে সাহায্য করতে আমি সাগ্রহেই রাজি হয়ে গেলাম। (চলবে)

ছবি: লেখক

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199