ফেলেই দিলে

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 28 Oct 2021

1910 বার পড়া হয়েছে

Shoes

রেখে চলে যাচ্ছিলাম। মনে হলো যেন শুনতে পেলাম, ‘ফেলেই দিলে’? ব্যথাতুর ফিসফিসে কথা যেন। চমকে পেছন তাকালাম। না কেউ কোথাও নেই। শুধু পড়ে আছে চেয়ারটি। একটু আগেই ফেলে গেছি আমাদের আবাস-ভবনের ছ’তলার বর্জ্য ফেলার জায়গায়। না, আহামরি কোন চেয়ার নয়। সাধারন একটি বেতের চেয়ার – হাতলবিহীন, বসার জায়গাটি গোল, তার ওপরে সবুজ আচ্ছাদনের কুশন। রুজভেল্ট দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার সময়ে বুড়ো এ চেয়ারটি বলি হয়েছে ফেলে দেয়া জঞ্জাল সামগ্রীর মধ্যে। হঠাৎ কেমন যেন মায়া হলো। কত পুরোনো চেয়ার – ২৭ বছরের সাথী। ১৯৯২ তে যখন নিউইয়র্কে আসি, তখন এসেছে আমাদের সঙ্গে। এর সঙ্গী-সাথীদের আর কেউ নেই। শুধু সেই ই একা এবং অদ্বিতীয় হয়ে টিঁকে ছিলো এতকাল। আজ সেও বিদায় নিলো।

ঢাকা ছেড়ে আসার আগেই বাড়ীর কাঠের আর কিছু বেতের আসবাব-পত্র দিয়ে এসেছিলাম নানান জনকে। তখনই ঠিক করেছিলাম যে, নিউইয়র্কে সব আসবাবপত্র হবে দেশী বেতের। বেতের আসবাব পত্রের দিকে ভীষন ঝোঁক ছিলো আমাদের দু’জনেরই। ঢাকাতেও খোলা যায়, আটকানো যায় এমন ভারী সুন্দর একটি বসার ঘরের সোফা বানিয়ে দিয়েছিলো আমাদের পূর্ব পরিচিত গ্রীন রোডের জালালাবাদ কেইন শপ। এবারও তাদের দুয়ারেই ধর্ণা দেয়া গেলো।
আসাম থেকে বেত এনে বানিয়ে দিলেন তারা সবকিছু। কি নেই সেই তালিকায়? প্রচলিত আসবাব পত্রতো ছিলই, তার সঙ্গে যোগ হলো পুরো বেতের দুলুনী চেয়ার, খাবার টেবিল, স্হান বিভাজনকরণ আসবাব, পড়ার টেবিল দু’কন্যা  ও আমাদের জন্যে, এমনটি নানান ছাঁদের বেতের ঢাকনাওয়ালা বাতি। আমরা হতভম্ব! দোকানের মালিক জানালেন, বহু অপ্রচলিত জিনিষ এই প্রথমবার তারা বানিয়েছেন। কিন্তু কি নিষ্ঠা, কি যত্ন, কি পরিশ্রম ও কি উদ্ভাবনী কুশলতা নিয়ে যে তাঁরা জিনিসগুলে বানিয়েছিলেন, তাতে মনে হয়, এ পুরো প্রক্রিয়াটিকেই তাঁরা একটি পবিত্র শিল্পসাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

চেয়ারটি এসেছিলো আমার বেতের লেখার টেবিলের সঙ্গে। কিন্তু সেই টেবিলটি একটু বেশী উঁচু ছিলো বলে প্রথম একযুগে সে চেয়ার বেশী ব্যবহৃত হয় নি লেখার কাজে। চেয়ারটি নতুন জীবন লাভ করল ২০০৪ সালে বিশেষ একটি কারনে। ও বছরই আবাসন পরিবর্তনের সময় এক যুগের পুরোনো বাড়ীর সব বেতের আসবাব পত্র ফেলে দিয়ে নতুন আসবাব কেনা হলো। কিন্তু শুধু মাত্র এই চেয়ারটি রেখে দেয়া হলো, কারন আমাদর কনিষ্ঠা কন্যার রেখে যাওয়া পাইন কাঠের টেবিলটির সঙ্গে এ চেয়ারটিতে বসে বেশ আয়েশে লেখা যায়। সুতরাং বিরানব্বুইয়ের বংশলতিকার সবেধন নীলমনি এ আসনটিই থেকে গেলো এবং পরিবারের মধ্যে এর নাম হয়ে গেলো ‘বাবার চেয়ার’।

গত ১৫ বছরে কত কাজ করেছি এ চেয়ারে বসে, কতকিছু লিখেছি কম্প্যুটারে ঐ চেয়ারে বসেই তো। গত দশকে আমার চারটে বই লেখা হয়েছে ঐ চেয়ারে বসেই। তবে জনান্তিকে বলে রাখি, আমার লেখা-পড়ার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে বিছানা। বই, খাতা-পত্র, পেন্সিল-কলম, কম্প্যুটার এবং সঙ্গে এক মগ কফি নিয়ে বিছানায় উঠতে পারলেই সবচেয়ে আনন্দ আমার। এর জন্যে কত যে বকা খেয়েছি নানান জনের কাছে এ জীবনে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কিছুই নিরস্ত করতে পারে নি আমাকে। সুযোগ পেলেই পড়ার টেবিল-মেবিল ছেড়ে ঐ বিছানার সুখশয্যায়। এ ব্যাপারে শিব্রাম চক্কোত্তি আমার গুরু – পড়ানো, গড়ানো সব ঐ ছড়ানো শয্যাতেই। আজকাল অবশ্য একটু উন্নতি হয়েছে – শয্যা ছেড়ে দুলুনী চেয়ারে স্হানান্তরিত করেছি নিজেকে। কিন্তু তবু মনে হলেই সেই শয্যা – কোন লজ্জা ছাড়াই।

কতজন বসেছেন ঐ চেয়ারে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন আমাদের বাড়ীতে এলে কোন কিছু লেখার হলেই ঐ চেয়ারে। ড: মাহবুবুল হক ঐ চেয়ারে বসেই বহু লেখা পড়েছেন আমার। আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ওখানে বসেই তাঁর এক বইয়ের মুখবন্ধ লিখে ফেলেন। আর শিল্পের ওপরে পুরো একখানি বই লিখে ফেলেছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী – সেও ওই চেয়ারেই উপবিষ্ট হয়ে। ভারী প্রিয় ছিলো তাঁর জানালার ধারের জায়গাটি – যেখান থেকে পূর্বী নদী দেখা যেতো।

গত ক’দিনে এ আবাসন ত্যাগের প্রক্রিয়ায় যখন বাকী সব জিনিষপত্র চলে গেছে, তখন এ বেতের চেয়ারটিই তো ছিলো আমার এক বিশাল আশ্রয়। ওটার ওপরে বসে খেয়েছি, কাগজপত্র গুছিয়েছি, রাতে জলের বোতল রেখেছি। তা’ছাড়া উঁচু থেকে কিছু পাড়তে হলে ওর ওপরে দাঁড়িয়েছি, কম্প্যুটার ওটার ওপরে রেখেই লেখার কাজ করেছি এবং কেউ এলে ওখানেই বসতে দিয়েছি।

এ জীবনে আমাকে অনেক দিয়েছে চেয়ারটি নি:স্বার্থ ভাবে। কথিত আছে যে, শ্মশানে, রাজসভায়, দুর্ভিক্ষে যে সঙ্গে থাকে, সেই হচ্ছে বন্ধু। না, চেয়ারটি এর কোনটিই করেনি। তবু সে আমার পার্শ্বেই ছিলো আমার সঙ্গে সুখে-দু:খে, আনন্দ-বেদনায়, হাসি-কান্নায়। গত তিন দশক আগে নানান বেতের আসবাবপত্রের মধ্যে সেই তো রয়ে গেছে আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত। বান্ধব তো সে আমারই। আজ সময়ের দাবী মেটাতে তাকেও ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছি। মনটা কেমন যেন করে উঠলো। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে খুব আলতো করে চেয়ারটায় গায়ে হাত রাখলাম। মনে হল যেনো শুনলাম, ‘ভালো থেকো, বন্ধু’।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199