ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ২

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 4 Nov 2021

2810 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেও বেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

দুই.

আমাদের বাড়ির দু-তিনটে বাড়ির পরে একটা বাড়িতে আমি প্রায় রোজই যেতাম আমার সমবয়সী আরেকটি শিশুর সঙ্গে খেলতে। ঐ বাড়ির সামনের ঘরে একটা টেবিলের উপর একটা বড় গোলাকৃতি ঘড়ি বসানো থাকতো। ঘড়িটায় দম দিতে হতো তার ডালা খুলে একটা ছোট ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে, বাড়ির বড়দের কাউকে সেটা করতে আমি মাঝেমাঝেই দেখতাম। কী কারণে জানি না, ঘড়িটার দুটো কাঁটার উপর আমার খুব লোভ ছিলো, ডালা খুলে কাঁটাদুটো হস্তগত করার জন্য আমার হাত নিশ্পিশ্ করতো তাদের দিকে চোখ পড়লেই। কিন্তু বাড়ির লোকদের চোখ এড়িয়ে সেটা করা তো সম্ভব ছিলো না, তাই অনেক কষ্টে লোভ সংবরণ করে তাদের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে কেবল তাকিয়েই থাকতাম। এরই মধ্যে একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ বিমানহানার সাইরেন বাজতে শুরু করলো। দিনের ঐ সময়টাতে প্রত্যেক বাড়ির প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা সবাই যে যার অফিসে, গোটা পাড়াতেই তখন মহিলারা আর বাচ্চারা ছাড়া আর বিশেষ কেউ নেই। সাইরেনের আওয়াজ কানে আসার সাথে সাথেই মহিলারা সবাই বাচ্চাকাচ্চাদের হাত ধরে ছুটলেন শেল্টারের দিকে, মুহূর্তের মধ্যে পাড়া একেবারে শুনশান। কিন্তু ঐ দিন কীভাবে যেন আমি মায়ের বা অন্যদের চোখ এড়িয়ে বাড়িতেই থেকে গেলাম। সাইরেন তখনও বেজেই চলেছে আর আমি এক পা-দু’পা করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম চারদিক খাঁ-খাঁ করছে, কেউ কোথাও নেই, সব বাড়িরই দরজা খোলা। আস্তে আস্তে আমার ঐ খেলার সাথীর বাড়ির সামনে এসে দেখি সেখানেও কেউই নেই কিন্তু হাট করে খোলা দরজা দিয়ে আমার চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে টেবিলের উপরে বসানো ঘড়িটা। সুবর্ণ সুযোগ! ছুটে ঘরের ভিতরে ঢুকে ঘড়ির ডালা খুলে কাঁটাদুটো খপ্ করে টেনে তুলে নিয়েই আবার এক ছুটে বাড়ির বাইরে। হাঁপাতে হাঁপাতে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসার প্রায় সাথে সাথেই বিমানহানার সাইরেন বাজা বন্ধ হয়ে ‘অল-ক্লীয়ার’ সংকেত বাজতে শুরু করলো আর সমস্ত বাড়ির লোকজনও তাড়াহুড়ো করে শেল্টার থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। গত কয়েক মিনিটে কিন্তু আমার মা বা অন্য কেউ খেয়ালই করেননি যে এতক্ষণ আমি তাঁদের সঙ্গে ছিলাম না, মনে হয় ওঁরা ভেবেছিলেন শেল্টারে আরো পনেরো-কুড়িজন বাচ্চার মধ্যে আমিও আছি।

যাই হোক, সবাই যে যার বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার পর আবার সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে লাগলো, কিন্তু আসল মজার ঘটনাটা ঘটলো আরো ঘন্টাদুই পরে। ততক্ষণে আমাদের, অর্থাৎ ছোট ছেলেমেয়েদের, বাবা-কাকারা যে যার কর্মস্থল থেকে ফিরতে শুরু করেছেন। হঠাৎ আমার ঐ খেলার সাথী বন্ধুর বাড়ির দিক থেকে একটা শোরগোল শোনা যেতে লাগলো, যেন কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিয়ে বাড়ির লোকরা কিছুটা উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছেন , “অবাক কা-! ¬ এমনটা আবার হয় নাকি?”  “সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিন্তু কেবল ওগুলো নেই কী করে এটা সম্ভব!” ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা আমি নিজে যে ঠিকঠাক শুনেছিলাম কিংবা শুনলেও বুঝতে পেরেছিলাম তা বলতে পারবো না, তবে আমার মাকে দেখলাম কৌতুহলী হয়ে দ্রুত পায়ে সেদিকে চলে যেতে। চার-পাঁচ মিনিট বাদে মা ফিরে আসার পর শুনলাম তিনি বাবাকে (যিনি ততক্ষণে অফিস থেকে ফিরেছেন) বলছেন, “সত্যিই অদ্ভূত ব্যাপার। ওদের বসার ঘরে টেবিলের উপরে যে ঘড়িটা থাকে না? - সেটার কাঁটাদুটো উধাও! কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।” বাবা অবশ্য কিছুটা নিঃস্পৃহ স্বরে বললেন, “আরে যাবে কোথায়? পড়ে আছে কোন আনাচে-কানাচে।” মা বললেন, “না গো, কোত্থাও নেই, ওরা অনেক খুঁজেছে।” আশপাশের কয়েকটা বাড়িতে এই ধরনের কথাবার্তা আরো কিছুক্ষণ ধরে চললো আর বড়দের কথা শুনতে শুনতে আমার বুক গর্বে ভরে উঠতে লাগলো, কারণ যে কথাটা কেউ জানে না সেটা কেবল আমিই জানি। কয়েক মিনিট পর আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়ালাম আর গম্ভীর গলায় বললাম, “আমি জানি কাঁটাদুটো কোথায় আছে।” সকলেই তো অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড, তারপর একজন জিজ্ঞাসা করলেন, “বল্ তো কোথায় আছে?” আমি এক হাত তুলে এক পড়শির বাড়ির দিকে দেখিয়ে বললাম, “ঐ বাড়ির ছাদে।” কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর ঐ বাড়ির কেউ দ্রুত ছাদে উঠে গেলেন, তার পরেই সেখান থেকে তাঁর বিস্মিত কণ্ঠ শোনা গেলো, “আরে, তাই তো! এখানেই তো পড়ে রয়েছে!” তাঁর উঁচু করে তোলা হাতের দুই আঙুলে ধরা ঘড়ির কাঁটাদুটো নিচে দাঁড়ানো সকলেরই চোখে পড়লো, আর সকলে এতটাই হতভম্ব হয়ে গেলেন যে আমি কী করে এটা জানলাম তা জিজ্ঞাসা করার কথা ঐ মুহূর্তে কারো মনেই এলো না। আসলে যা হয়েছিলো তা হলো, আমার খেলার সাথীর বাড়ি থেকে কাঁটাদুটো হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার এত দিনের লোভ আচমকা একেবারেই উবে গিয়েছিলো। তাদের প্রতি আমার আকর্ষণের কোন বাস্তব কারণ তো সত্যিই ছিলো না, তাই হাতে পেতে না পেতেই আমার মনে হলো আমি আর চাই না ওগুলো, আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাঁটাদুটো আমি ঐ বাড়ির ছাদ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। শিশুমনের এই বিচিত্র খামখেয়ালিপনার কারণ হয়তো মনস্তত্ববিদ্রা ব্যাখ্যা করতে পারবেন। মনে আছে, পরে মায়ের প্রশ্নের উত্তরে আমি সরলভাবেই আমার কৃতকর্মের বিবরণ দিয়েছিলাম। আমার স্বীকারোক্তি তিনি নিশ্চয় পড়শিদেরও জানিয়েছিলেন, কিন্তু কেউই এজন্য আমাকে তিরষ্কার করেছিলেন বলে মনে পড়ে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলেছিলো, সবাই জানেন, ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বার মাস থেকে ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বার মাস পর্যন্ত। সুতরাং যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময়ে আমার বয়স ছিলো প্রায় বছর ছয়েক। যুদ্ধ চলাকালীন তো কেবলমাত্র সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত লোকজন ছাড়া অন্য সমস্ত লোকের বর্মা আর ভারতের মধ্যে যাতায়াত কার্যত বন্ধ ছিলো। বেসামরিক যাত্রী বহনকারী কোন জাহাজই ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে চলাচল করছিলো না এবং সাধারণ যাত্রীদের জন্য বিমানপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা তখনও চালু হয়নি। যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরেও বেশ কয়েক দিন লেগে গেলো সাধারণ যাত্রীবাহী জাহাজের সমুদ্রযাত্রা শুরু করার ছাড়পত্র পেতে। পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ার সাথে সাথেই আমার বাবা ব্যবস্থা করলেন মায়ের সঙ্গে আমাকে ভারতে ফেরত পাঠানোর। বাবার নিজের তখনও বর্মা ত্যাগের অনুমতি ছিলো না, কারণ যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সরকারী কর্মকর্তাদের আরো কিছুদিন সে’দেশে থেকে যাওয়ার দরকার ছিলো বিভিন্ন দফ্তরের কাজকর্মের তত্বাবধান করার জন্য। কেবল আমার বাবা নন, অন্যান্য সরকারী দফ্তরের ভারতীয় অফিসারদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিলো ঐ সময়ের নিয়ম। তাই বাবাকে রেঙ্গুনে রেখেই মা ও আমি ফিরে এলাম ভারতে, অসমের গৌরীপুরে আমার মামাবাড়িতে। বাবার ফিরে আসার অনুমতি পেতে আরো বেশ কয়েক মাস, প্রায় বছরখানেক, লেগে গেলো। অর্থাৎ বর্মায় ব্রিটিশ সরকারের ‘এ.জি. বেঙ্গল’ নামক বিভাগটির কাজকর্মেরনতুন ব্যবস্থা করার কাজ সম্পুর্ণ হওয়ার পরই তিনি ও তাঁর মতো আরো কয়েকটাদফ্তরের কর্মকর্তারা ফেরার সুযোগ পেলেন। ভারতে ফেরার পর তখনকার মতো তাঁর কর্মস্থল হলো কলকাতা। ততদিনে সম্ভবত ব্রিটিশ সরকারের ভারত থেকে পাততাড়ি গোটানোর প্রস্তুতি তলায় তলায় শুরু হয়ে গেছে, তাই বাবাকে আবারও বর্মায় ফেরত যেতে হলো না। (চলবে)
ছবিঃ গুগল 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199