দুলছে হাওয়ায়

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 9 Dec 2021

2175 বার পড়া হয়েছে

Shoes

রুজভেল্ট দ্বীপে আমাদের ছ’তলা বাড়ীর বারান্দার দুলুনী চেয়ারটি আমার খাবার টেবিল থেকে দিব্যি দেখা যায়। আজও সকালে প্রাত:রাশের সময়ে তাকিয়ে ছিলাম ওটার দিকে। আহা, শীতের সময়ে বড় অযত্নে পড়ে থাকে বেচারী! তখন ঠান্ডায় বারান্দায় যাই না, ঝাড়-পোছ করি না চেয়ারটাকে, বসাও হয় না ওটায়। ওর সময় রমরমা বসন্ত ও গ্রীষ্মে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম হঠাৎ চেয়ারটা দুলে উঠলো। মনে হলো, দৃষ্টিবিভ্রম কি? একটু পরেই বুঝলাম, না, সত্যিই ওটা থেমে থেমে দুলছে। ‘দুলুনী চেয়ার দুলছে’ – ভাবতেই মজা লাগলো। দুলুনী চেয়ার তো দুলবেই। পরক্ষণেই মনে হলো, কেউ ওটাতে বসে থাকলেই না তবে ওটার দোলার কথা। কেউ তো ওটাতে বসে নেই, তা’হলে চেয়ারটা দুলছে কেন? বোঝা গেলো, আসলে ওটা নচিকেতার ‘নীলাঞ্জনা’র মতো ‘দুলছে হাওয়ায়’।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চারপাশের ‘চরাচর যেন লুপ্ত হয়ে গেলো’। পরিস্কার দেখতে পেলাম, আবছা অবয়বে হাসি হাসি মুখে ঐ চেয়ারে বসে আছেন আমার ব্যক্তিত্বময়ী মাতামহী। মনে আছে, প্রায় ৬০ বছর আগে তাঁর পিতৃ-নিবাসের তেতলার চিলেকোঠার পাঠকক্ষের সামনের চাতালে প্রথম দেখেছিলাম দুলুনী চেয়ার।

ফেনীর দু’স্টেশন পরে শর্ষদিতে তাঁর পিতৃনিবাস দেখাতে শুধু আমাকেই নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বড় সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবার তাঁরা। বৃটিশ আমলে তাঁর অগ্রজ পুরো নোয়াখালী জেলার প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলে। ভারী সুন্দর দোতলা বাড়ী তাঁদের, সামনে টলটলে জলের দীঘি, বাড়ীর পেছনে নানান বৃক্ষের উদ্যান। বালক আমি – মুগ্ধ হয়েছিলাম।

তবে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো চিলেকোঠার পাঠকক্ষটি। কত যে বই সেখানে – সেই ঘরের পুরোনো বইয়ের গন্ধ এখনো আমার নাকে লেগে আছে, বইয়ের ওপরের সূক্ষ্ম ধূলোর আস্তরন। সেই পাঠকক্ষের চাতালে পাতা ছিলো একটি দুলুনী চেয়ার। সেটাতেই বসে আমার মাতামহী গল্প বলছিলেন তাঁর বাড়ীর। তাঁর পদপ্রান্তে বসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আমি।

আস্তে আস্তে ঐ দুলুনী চেয়ার থেকে আমার মাতামহীর ছবি মুছে গেলো। অপসৃয়মান সে ছবিতে জায়গা করে নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম রাষ্ট্রপ্রধান জন ফিটজেরাল্ড কেনেডী। মনে পড়লো, ষাটের দশকের প্রথম দিকে দুলুনী চেয়ারে তাঁর একটি ছবি আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। তরুন রাষ্ট্রপ্রধান জন কেনেডী একটি দুলুনী চেয়ারে বসে আছেন – ভাবনা-নিমগ্ন তিনি। আমার দুলুনী চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হলো, আমার মাতামহীর আবছা অবয়ব সরে গিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কেনেডী।

আমার বাবার কথাও মনে পড়ছে। না, তিনি কোন দুলুনী চেয়ারে বসতেন না। তিনি বসতেন যাকে সোজা ভাষায় বলে ‘ইজি চেয়ারে’ – প্রমিত বাংলায় ‘আরাম-কেদারা’। একটি ভারী সোজা-সহজ কাঠের কাঠামোয় মোটা ক্যানভাসের কাপড় দু’দিকে দু’টো ডান্ডার মধ্যে ঢুকিয়ে আসন তৈরী হতো – যেটাতে আধ-শোয়া ভঙ্গিতে বসা যেতো। আমাদের বরিশালের বাড়ীর বারান্দায় সেই ‘আরাম-কেদারায়’ তিনি প্রায়ই বসে থাকতেন – চা খেতেন, ধূমপান করতেন, খবরের কাগজ পড়তেন।

কখনো কখনো চুপ করে অনেক দূরে তাকিয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে ভারী জানতে ইচ্ছে করতো আমার, কি ভাবেন তিনি। তা জানার আর কোন জো নেই। কি আশ্চর্য্য, আজ কেন জানি, বাবাকে তাঁর ইজিচেয়ারে দেখছি না, তাঁকে দেখছি বারান্দার ঐ দুলুনী চেয়ারে।

আমার পিতামহী যখন আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসতেন, তখন তাঁর পুত্রের ইজিচেয়ারে তিনি বসতেন। বড় স্বল্পভাষী ছিলেন তিনি।বেশীর ভাগ সময়েই চুপচাপ বসে থাকতেন তিনি। হয়তো ফেলে আসা জীবনে কথা ভাবতেন – মাত্র ১১ বছর বয়েসে বঁধু হয়ে এসেছিলেন তিনি শ্বশুর বাড়ীতে। নয় তিনি সামনের দিনগুলোর কথা ভাবতেন – জানতেন তিনি, সময় তাঁর ফুরিয়ে আসছে। আসা-যাওয়ার পথে আমি থামতাম, হেসে জিজ্ঞেস করতাম, ‘কি করো, গিন্নী?’ স্মিত মুখে তিনি বলতন, ‘ভাবি।’ ‘কি, এতো ভাবো?’, পাল্টা হেসে বলতাম। জবাব দিতেন না তিনি, দূরে তাকিয়ে থাকতেন। মনে হলো, বাবার ইজিচেয়ারে নয়, আমার বারান্দার দোদুল্যমান দুলুনী চেয়ারে যেন তিনি বসে আছেন।

হঠাৎ করেই যেন চেয়ার দুলে উঠলো। আমার পিতামহীর চেহারাটা ভেঙ্গে গেলো এক নিমিষে। অবাক হয়ে দেখি কত প্রয়াত প্রিয় মানুষেরা, যাঁরা কি না নানান সময়ে আমাদের বাড়ীতে এসেছিলেন, দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের খোলা বারান্দায়, তাঁদের আবছা দেহাবয়ব ঐ দুলুনী চেয়ারে দেখতে পাচ্ছি। অনেকটা ছায়াছবির মতো। ঐ তো মাহবুব (প্রয়াত ড: মাহবুবুল হক) আয়েশ করে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। দেখেছো, মিশুটা (প্রয়াত মিশুক মুনীর) কেমন আধশোয়া হয়ে মিট মিট করে দুষ্টুমীর হাসি হাসছে। দেখতে পাচ্ছি সিমিন আপা (প্রয়াত ড: সিমিন মাহমুদ ) দুলুনী চেয়ারে বসে মাথার ওপরে হাতদু’টো তুলে নিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন নদীর ওপারে।

‘ক্রিং ক্রি’- কর্কশ স্বরে মুঠোফোন বাজতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। কি আশ্চর্য্য, কতক্ষন এমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম! কত প্রয়াত প্রিয়জনকে দেখলাম বারান্দার দুলুনী চেয়ারে – আমার মাতামহী, পিতামহী, পিতা আরে কতজনকে। মনটা হু হু করে উঠল। কেমন যেন মনে হলো,

‘আজ তারা কই সব?
ওখানে হিজল গাছ ছিল এক –
পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার,
তারপর কী যে তার মনে হল কবে
কখন যে ঝরে গেল,
কখন ফুরাল,
আহা–চলে গেল কবে যেন নীরবে।

কোথায় গিয়েছে তারা?
অই দূর আকাশের
নীল লাল তারার ভিতরে
অথবা মাটির বুকে
মাটি হয়ে আছে শুধু
– ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে?’

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199