নাম না জানা মেয়েটি

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 11 Nov 2021

1965 বার পড়া হয়েছে

Shoes

চোখে পড়েছে বেশ ক’বার, বেশ ক’মাস ধরেই। নদী পারাপারের আমাদের রুজভেল্ট দ্বীপের ঝুলন্ত বগিটি যখন পূর্বী নদী পেরিয়ে তৃতীয় স্তম্ভটির মাথা পেরোয়, তখনই চোখ যায় বগির গমন পথের পার্শ্বের সুউচ্চ কাঁচঢাকা কালো হর্ম্যটির দিকে। আবাসিক ভবন ওটা – তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। কাঁচের ফাঁকে দেখা যায় নানান বাড়ীর নিত্যনৈমিত্তিক ঘরকন্নার দৃশ্য – কোন বাড়ীর রান্নাঘরে কোটাকুটি চলছে, কোন বাড়ীর শোবার ঘরে বাচ্চাকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে কোন তরুনী মা, কোথাও বসার ঘরে টেলিভিশন। যাপিত জীবনের নানান বর্ণাঢ্য চিত্র। ওর মধ্যেই বেশ উপরের দিকের একটি বাড়ীতে দেখেছি মেয়েটিকে বেশ কয়েকবার গত কয়েক মাসে।আমাদের বগিটি ওই ভবনের সমান্তরাল হলেই দেখা যায় তাকে। সেই সঙ্গে বোঝা গেছে তিনটে বিষয়। প্রথমত: বাইরে থেকে যতটা আন্দাজ করা যায়, তা’তে মনে হয় এ বিশোর্ধ যুবতীটি ক্যারিবীয় অঞ্চলের। মাজা রং, দোহারা গড়ন। মাথার চুল উঁচু করে বাঁধা। কিন্ত তাকে সবসময়েই দেখা যায় এক পোশাকেই – কালো প্যান্ট আর কালো জামায়। হের ফের হয়নি এ পোশাকের কখনও।

দুই, সবসময়েই সে কর্মরত – ঘরের কোন না কোন কাজ করছে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে সে কাজ বদলায়। যেমন, দশটায় যদি নদী পার হই, তা’হলে দেখি, মেয়েটি একরাশ কাপড় নিয়ে ইস্ত্রি করছে। এক ঘন্টা আগে যদি বগিতে থাকি, তা’হলে দেখি সে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। যেদিন একটু দেরী করে ১১টায় বেরুই, তা’হলে অভ্রান্তভাবে চোখে পড়ে সে রান্নাঘরে কর্মরত। গত ক’মাসে এ সময়সূচীর কোন ব্যাতয় হয়নি।এ সব দেখে শুনে তৃতীয় যে বিষযটি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি, তা’হোল মেয়েটি গৃহকর্মী। সর্বদা তার চোখ কাজের দিকে নিবদ্ধ। কখনোই তাকে চোখ তুলে তাকাতে দেখিনি কোন দিকে। দেখে মনে হয়, সম্পূর্ণ নিস্পৃহ সে এ জগত সংসারের প্রতি। তার ঝুঁকে পড়ে কাজ করা, দাঁড়ানোর ভঙ্গী, হাতের আন্দোলনে কেমন যেন একটা ক্লান্তির ভাব সুস্পষ্ট। যেন সে নিজেকে বয়ে বেড়াচ্ছে জোর করে – আর সে পারছে না।

মেয়েটিকে দেখে আমার মনে হয়েছে, হয়তো তাকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়।হয়তো সকাল ৮ টায় কাজ শুরু করে তার কাজ শেষ হ’তে রাত আটটা বেজে যায়। হয়তো তার একজন মনের মানুষ আছে। তার কথা ভেবে কখনো কি মেয়েটির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে না – কোন স্মৃতির কথা, কোন হাসির বাক্য, কোন দুষ্টুমির ঘটনা? হয়তো মেয়েটি একটি তরুনী মাতা। তার একটা শিশু কন্যা আছে, যাকে সে বাড়ীতে রেখে আসতে বাধ্য হয়। কে দেখে রাখে শিশুটিকে? কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঐ কচি মুখটির কথা কি তার মনে পড়ে না? হয়তো!

মেয়েটি কি রেখে এসেছে তার মা-বাবাকে তার দেশে। ভাই-বোন আছে তার? এ শহরে কোথায় থাকে সে? কাজের শেষে কি করে ঘরে ফিরবে সে? যে বাড়ীতে সে কাজ করে, তার দামী দামী দ্রব্যসামগ্রী নাড়তে-চাড়তে গিয়ে তার মনে কি জন্ম নেয় কোন বেদনা, কোন ঈর্ষা, কোন ক্ষোভ? স্বপ্ন আছে কি তার কোন -এই যেমন, সে আরো লেখা-পড়া করবে কোন একদিন, এ কাজ ছেড়ে আরো কোন ভালো কাজ করবে, মা-বাবাকে নিয়ে আসবে এই দেশে, মনের মতো সংসার পাতবে?

এ সব ভাবতে ভাবতে মনে হলো মেয়েটিতো বিশ্বব্যপী সেই ৬ কোটি ৮০ লক্ষ গৃহকর্মীদের একজন, যার ৮০ ভাগই নারী। আরব বিশ্বের উপসাগরীয় দেশগুলোতে ৫১ লক্ষ মহিলা গৃহকর্মী কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত আছেন ১৮ লক্ষ।ভারতে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি হচ্ছে ৪২ লক্ষ।এ মানুষগুলোকে না হলে আমাদের জীবন তো অচল। তারা নিরন্তর কাজ করছে নিজ দেশের ভেতরে এবং বাইরে – পেছনে ফেলে আসছে তাদের প্রিয়জন, সংসার, সবকিছু। এসব মানুষেরা না হ’লে আমরা চলতে পারি না, কিন্তু আমরা কি কখনো ভাবি তাঁদের সংসার কে চালায়? আমাদের সন্তানদের দেখ-ভাল এ মানুষগুলো করছে, কিন্তু তাদের সন্তানদের কে দেখে?

বহু আগে ফরিদপুরে একটা দৃশ্য দেখেছিলাম, যা আজো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এক বাড়ীতে কাজ করতে আসা মা তাঁর ৫ বছরের শিশুটিকে উঠোনের একটি গাছের সঙ্গে কোমরে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন – যাতে তিনি কাজ করতে পারেন আর তার সন্তানটিও হারিয়ে না যায়।ঘরে-বাইরে গৃহকর্মীরা তো অত্যাচার, নির্যাতন আর লাঞ্চনারই শিকার অহরহ। আঠারো ঘন্টা ধরে কাজ করানো, খাদ্যের বঞ্চনা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সকল মানবিক অধিকার ও স্বাধীনতার খর্বীকরণ, মানুষের ন্যূনতম মর্যাদার লঙ্ঘন – এ সবই তো দেশে-বিদেশে গৃহকর্মীদের জীবনালেখ্য। মানব উন্নয়ন আর নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কত কথা হয়, কিন্তু সারা বিশ্বব্যাপী গৃহকর্মীদের জীবন-বঞ্চনা রূঢ় বাস্তবতা তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

মনে আছে, আজ থেকে ৩০ বছর আগে একটি গবেষনা-ভিত্তিক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল, ‘গৃহকাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তি : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’। একটি বড় আলেচনা সভায় উপস্হাপনও করেছিলাম। সে’দিনের উপস্হাপনের ছবিও একটা খুঁজে পাওয়া গেল সম্প্রতি। আমাদের দেশে ঐ বিষয়ের ওপরে খুব সম্ভবত: প্রথম কাজ সেটি।বিস্তৃত সাধুবাদ পেয়েছিল কাজটি। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন প্রশংসা করেছিলেন কাজটির ১৯৯৮ সালে তাঁর নোবেল বিজয় পরবর্তী ঢাকার বক্তৃতায়।আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে যে আমার লেখাটির প্রায় ১৫ বছর পরে আমাদের কনিষ্ঠা কন্যাও ঢাকার গৃহকর্মীদেরই বিষয়ের ওপরে লিখেছে তার স্নাতক অভিসন্দর্ভ বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক রাকা রায়ের তত্ত্বাবধানে। পরে সেটি গ্রন্হাকারেও বেরিয়েছে। আমার কাজের সস্নেহ স্বীকৃতি আছে তার বইয়ের ভূমিকায়।

পিতা-কন্যার কাজ দু’টো মাঝে মাঝে উল্টে-পাল্টে দেখি। বাংলা সাহিত্যের চারটি সাহিত্যকর্ম মনের মধ্যে নিত্য আনাগোনা করে – মহাশ্বেতা দেবীর দু’টো ছোট গল্প ‘আজীর’ ও ‘স্তন্যদায়িনী’ এবং রমাপদ চৌধুরীর দু’টো উপন্যাস ‘ ‘আশ্রয়’ ও ‘খারিজ’। সবক’টি গল্প-উপন্যাসই গৃহকর্মীদের জীবন ও জগত নিয়ে।কিন্ত এতো সব কিছুর পরেও নদী পারাপারের নিমিত্ত চলন্ত ঝুলন্ত বগি থেকে প্রায় সকালে দেখা ঐ নাম না জানা মেয়েটির জীবন-বাস্তবতার কোন ঠিকানা মেলে কি? পাওয়া যায় কি তার রূঢ় জগতের কোন থৈ? সত্যিই কি দেখতে পাই তাকে?

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199