ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ১৩

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 3 Mar 2022

2155 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

তেরো.

সপ্তাহখানেক বাদে একদিন ভদ্রলোকের ফোন পেলাম, ‘আগামী কাল একবার আসতে পারবেন নাকি?’ পরদিন তাঁর অফিসে ঢুকতেই তিনি এক গাল হেসে বললেন, ‘আরে আপনি তো প্রথমবারের চেষ্টাতেই কামাল করে দিয়েছেন, ভাই! আপনার তৈরী স্পটিং শীট মাণিকদার বেশ পছন্দ হয়েছে। সাব-টাইটল্ ছাপার কাজ শুরু করার ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন।’ টেবিলের ওপর থেকে একটা খাম তুলে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন তিনি, ‘নিন, এটা রাখুন। গুণে দেখুন ঠিক আছে কিনা।’ গুণে দেখলাম যে অংকটা তিনি প্রথমে বলেছিলেন, তার চেয়ে কিছুটা বেশিই যেন রয়েছে। আমার প্রশ্নসূচক দৃষ্টি দেখে তিনি বললেন, ‘বাজারের পুরো রেটই আপনাকে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে আরো কাজ তো করবেন আপনি। আপনার কাজ দেখে মাণিকদা বললেন দিব্যি হয়েছে। এমন ছেলেদের যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন এদের দিয়েই কাজ করাও, আমাকে ব্যতিব্যস্ত করার দরকার কী।’

এই হলো সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগের একেবারে প্রাথমিক ধাপ। তখনও কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেনি। সেটা ঘটলো আরো কিছুদিন পর। সুব্রত একদিন এসে বললো, ‘চলো, মাণিকদা ডেকে পাঠিয়েছেন। ওঁর বাড়িতে।’ গেলাম সুব্রতর সঙ্গে সত্যজিতের বিশপ্ লেফ্রয় রোড-এর বাড়িতে (রাস্তাটার এখন নতুন একটা নাম হয়েছে সত্যজিতের নামানাসুরেই, কিন্তু ঐ নামটা উচ্চারণ করতে বা লিখতে আমার বাধে)। একটু নার্ভাস্ ছিলাম, স্বীকার করছি, কিন্তু ওঁর সহজ, স্বাভাবিক ব্যবহারে নার্ভাস্নেস্ কেটে যেতে সময় বেশি লাগলো না। আন্তরিকভাবেই বললেন, ‘বেশ ভালো কাজ করেছো। তোমার ইংরেজি লেখার স্টাইল বেশ কম্ফর্টেবল্।’ আমার ইংরেজি লেখার স্টাইল সম্পর্কে এই বিশেষণটি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শুনলাম। প্রথমবার শুনেছিলাম কলেজে পড়ার সময় আমাদের প্রিন্সিপ্যালের মুখে, যিনি আবার ইংরেজি বিভাগের প্রধানও ছিলেন। তবে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের মুখে এই ধরনের প্রশংসাসূচক উক্তি শুনে আমি যারপরনাই আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছিলাম।

প্রায় ঘন্টাখানেক বা তার একটু বেশি ছিলাম এ’যাত্রায় সত্যজিতের সান্নিধ্যে। অনেক গল্প করলেন, রসিকতাও দু-একটা। আমার পড়াশোনার ব্যাপারে জানতে চাইলেন, কী করি তা নিয়েও প্রশ্ন করলেন। একটা কলেজে অর্থনীতি পড়াই শুনে খুব খুসী হলেন। বললেন, ‘মাঝে মাঝে চলে এসো, সময় পেলে।’ সত্যজিতের তৈরী ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিটির কথা তো পাঠকদের মনে আছে নিশ্চয়ই। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৭০ সালের অক্টোবার মাসে। একই বছরের নভেম্বার মাসে মুক্তি পায় মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটি। ঐ সময়ে কলকাতায় চলচ্চিত্রানুরাগী লোকজনের জন্য একাধিক ‘ফিল্ম-ক্লাব’ ছিলো। ‘নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটী’ নামে একটি ক্লাবের সদস্য ছিলাম আমি, যার মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন সত্যজিৎ। এই ফিল্ম সোসাইটী’র ত্রৈমাসিক পত্রিকায় সত্যজিৎ-মৃণালের এই দু’টি ছবি নিয়ে আমি ইংরেজিতে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম Ñ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড ইন্টারভিউ: টু ইমেজেস্ অভ্ দ্য সেভেন্টিজ্’ (Pratidwandi and Interview: Two Images of the ’Seventies)। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ সত্যজিৎ বললেন, ‘এনসিএফ্এস্-এর পত্রিকায় ঐ লেখাটা তো তোমারই, তাই না?’ আমি মাথা নাড়তে বললেন, ‘লেখাটা মন্দ হয়নি। ঠিকই ধরেছো, একই দৃষ্টিভঙ্গী দুটো ছবিরই পেছনে, তবে মৃণালবাবুর উপস্থাপনা অন্য ধরনের। আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে।’ সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়ার সঙ্গে সেদিন আলাপ হয়নি, উনি বোধহয় বাড়িতে ছিলেন না। পুত্র সন্দীপ ছিলো, সে তখন তেরো-চোদ্দ বছরের বালক বা কিশোর। পরে অবশ্য বিজয়াদির Ñ ঘনিষ্ঠদের কাছে ‘মঙ্কুদি’ Ñ সঙ্গে পরিচয় তো হয়েইছে। তবে ওঁকে ‘মঙ্কুদি’ বলে ডাকতে কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকেছে বরাবরই, তাই ‘বৌদি’ বলেই ডেকেছি। উনি অবশ্য তাতে কোন আপত্তি করেননি। ওঁকে ‘বৌদি’ ডাকতে শুনেছি যেন আরো দু-একজনকেও। সত্যজিৎ রায়কে অবশ্য অন্যান্যদের মতো ‘মাণিকদা’ সম্বোধন করা রপ্ত হয়ে গিয়েছিলো কিছুদিনের মধ্যেই।

‘চিড়িয়াখানা’ (The Zoo) ছাড়াও সত্যজিতের তৈরী আরো দু’টি ছবির সাব-টাইটল্ রচনার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। সুযোগ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন, কোন ধরনের অতি-ব্যস্ততাজনিত সময়াভাবের দরুন। ঐ দু’টি ছবি হলো ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (Days and Nights In The Forest) এবং ‘অশনি সংকেত’ (Distant Thunder)। এই ছবিদু’টির ইংরেজি নামকরণ সত্যজিতের নিজেরই। আমার কাজে সত্যজিৎ সন্তুষ্টই হয়েছিলেন, যতদূর জানি। ততদিনে সত্যজিতের ছবির সাব-টাইটল্ রচনার কৃতিত্বের সুবাদে আরো কিছু ছবির কাজের বরাতও আমার কাছে আসতে শুরু করেছে। মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, সলিল দত্ত, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ পরিচালকরা ছিলেন এইসব ছবির নির্মাতা। শেষোক্ত জনের, অর্থাৎ নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অচিরেই অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিলো। তাঁর প্রায় সব ছবিরই কাজ আমি করেছি। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আজ-কাল-পরশুর গল্প’ উপন্যাসটি অবলম্বনে নব্যেন্দুর তৈরী ছবি (একই নামের) কানাডা’র মন্ট্রীয়াল-এ আয়োজিত কমনওয়েলথ্ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ প্রদর্শিত হয়েছিলো। উৎসবের আয়োজকদের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নব্যেন্দুর সঙ্গে আমিও মন্ট্রীয়াল-এ গিয়েছিলাম। ঐ উৎসবে নব্যেন্দুর ছবিটি ‘চিত্রনাট্য’ এবং ‘সাব-টাইটল্’ এই দুই বিভাগে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেছিলো।

প্রথমবার সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে যাওয়ার পর আরো বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছি, ৮০’র দশকের মাঝামাঝি আমি বিলেতে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। তবে প্রতিবারই কোন না কোন কাজে গিয়েছি, কখনো নিজে থেকেই, কখনো তাঁর ডাক পেয়ে। তাঁর ইউনিটের অন্যান্যরা, যেমন সুব্রত ও তার সহকর্মীরা, প্রায় প্রতিদিনই তাঁর বাড়িতে একবার হাজিরা দিতো। সেটা আমি কখনো করিনি, অর্থাৎ বিনা দরকারে কখনো যাইনি। আসলে আমি তো তাঁর ইউনিটের নিয়মিত অংশ ছিলাম না। সেজন্য সত্যজিতের সঙ্গে চিরকালই আমার একটা ‘ফর্মাল’, কেজো সম্পর্ক ছিলো, সুব্রতদের মতো ঘনিষ্ঠ বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক কোন দিনই গড়ে ওঠেনি সেভাবে। ততদিনে আমি কলকাতার একটি অধুনালুপ্ত, কিন্তু সেই সময়ে পাঠক-সমাদৃত, ইংরেজি সংবাদপত্রে যোগ দিয়েছি। এই খবরটা শুনে সত্যজিৎ খুশি হয়েছিলেন, বলেছিলেন যে ঐ ‘হাউজের’ একজন সদস্য হওয়াটা সম্মানের বিষয়। কোন ক্ষেত্রে বা পেশায় পরিচিত যে কোন লোকের উন্নতির বা সাফল্যের কথা শুনতে পেলে তিনি সত্যিই আনন্দ পেতেন। বিলেত রওনা হওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। যে উদ্দেশ্যে আমার এই যাত্রা তা জেনে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এটাই ছিলো সত্যজিতের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ। আমার বিলেত প্রবাসকালেই তিনি প্রয়াত হন, ১৯৯২ সালে।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199