সবারে আমি নমি

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 4 Nov 2021

1845 বার পড়া হয়েছে

Shoes

দেরাজ খুলতেই সে দিকে চোখ গেলো। না, তেমন কিছু নয় – তিনটে পাসপোর্ট। তার একটি সবুজ রঙের বাংলাদেশের পাসপোর্ট – আমার এখনকার ভ্রমণ ছাড়পত্র। বাকী দুটো বাতিল – আমার জাতিসংঘের কর্মজীবনের কর্মময় সময়ের চিহ্ন। নীলটি ছিলো প্রথমদিকে, তারপর পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লাল পাসপোর্টে রূপান্তর। না, কোন দেশে নেয় নি তারা আমাকে? বিশ্বের ৮৫টি দেশে তারা আমাকে পৌঁছে দিয়েছে কোন প্রশ্ন ব্যতিকেকেই। শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান ছাড়পত্র তারা সন্দেহ নেই। তবে তার মধ্যে ঐ সবুজটিই হৃদয়-নাড়ানিয়া – যতবারই সবুজ পাসপোর্টটির দিকে চোখ যায়, ততবারই বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে ওঠে। আহ্, এক টুকরো বাংলাদেশ সর্বদা হৃদয়ে বহন করি।

আজ সকালেই কাগজপত্র গোছানোর জন্যে রুজভেল্ট দ্বীপে আমাদের বাড়ীর দ্বিতীয় শয়নকক্ষটিতে এসেছিলাম। নামে শয়নকক্ষ হলেও এবং শয়নের ব্যবস্থা থাকলেও ওটা আসলে আমার পড়াশোনার ঘর। সারা ঘরের দু’দিকের দেয়াল জুড়ে বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে হাজার ছ’য়েক বই, কাজ করার টেবিল, লেখা-পড়ার সরঞ্জাম সব মজুত সে কক্ষে। দিনের একটা বড় সময় আমার কাটে এখানে। আমাদের কন্যারা এলে তাদের বা কোন অতিথি এলে তাঁদেরও থিতু হয় এ ঘরেই।এখন এ ঘরের বিছানো ছাড়পত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কম দিন তো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করিনি – তেতাল্লিশ বছর। এম.এ. পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে। ফল বের না হওয়ায় প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায়নি। পঞ্চাশ বছর আগে একই পরিস্থিতিতে অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্তের নিয়োগের উদাহরন টেনে আমাকেও প্রথম নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো মাসিক ৪০০ টাকায় টিউটর হিসেবে। ১৯৭৬ সালের মার্চ নাগাদ ফল বেরুলে আমার নিয়োগের রূপান্তর ঘটে প্রভাষকে।

প্রায় দু’দশক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে কাজ করতে এলাম আন্তর্জাতিক বলয়ে ১৯৯২ সালে -জাতিসংঘে।কর্মস্থল নিউইয়র্কে। এ কাজেও তো প্রায় কাটালাম তিন দশক। হাসি-আনন্দে, সুখে-দু:খে, শোকে-বেদনায় এতোগুলো বছর কেটে গেলো! কর্মক্ষেত্রে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা, কত অনন্যসাধারন মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, কত প্রতিভাবান উদ্দীপ্ত তরুন-তরুনী কাজ করেছে আমার সঙ্গে।

বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফ:স্বল শহরের ছেলে আমি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান – বাবা কলেজ শিক্ষক ছিলেন, মার পড়াশোনা প্রাইমারী অবধি।না, কোন অভিজাত স্কুল কলেজে যাই নি – বাংলা মাধ্যমেরই ছাত্র।উচ্চশিক্ষা ঢাকা আর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে।যেখান থেকে এখানে এসেছি, সে আমার ভাগ্য বলে মানি, নমিত হই বারবার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন নোবেল বিজয়ীদের সঙ্গে কাজ করি, রাজা-রানী, যুবরাজ-রাজকুমারী, রাষ্ট্রপ্রধান-প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসি, অথবা বিশ্বের বিখ্যাত নামী-দামী সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে কথা বলি, তখন প্রায়ই সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয় – উৎপল দত্তের ভাষায় ‘প্রেত্যয় হয় না’।

কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে এটা ভাবতে যে এ জীবনে পৃথিবীর কতো দেশে গিয়েছি। আমার মতো মানুষের জন্যে সে যে কত বড় সৌভাগ্য! কি সব আশ্চর্য্য সে সব ভূখন্ড – দক্ষিন আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ, জর্ডানের মৃত সমুদ্র, ব্রাজিলের আমাজন অরন্য, জাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। সাহারার গরমে গা পুড়ে গেছে, আইসল্যান্ডের তুষার ঝড়ে পড়েছি, জাম্বিয়ার অরন্যে পথ হারিয়েছি, কেপ টাউনের লাঙ্গা বস্তিতে গিয়ে ভয়ে কেঁপেছি। রবেন দ্বীপে ম্যান্ডলার কারাবাসে গিয়ে মাথা নুয়ে গেছে, সেনেগালের গোরী দ্বীপে গিয়ে দাস প্রথার কথা ভেবে মন কেমন যেন হয়ে গেছে, ইয়েমেনের সন্ত্রাসের জায়গাগুলো দেখে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণায় মন ভরে গেছে।

কত রাজধানী থেকে রাজধানীতে গিয়েছি। শুধু গত বছরই মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ১৫ দিনে ১২টি রাজধানীতে উপস্হিত ছিলাম।তারমধ্যে ঢাকাও ছিলো। এক বিমান বন্দর থেকে আরেক বিমান বন্দরে পাড়ি দিয়েছি। কত শত হোটেলে যে থেকেছি, তার গোনা-গুনতি না করাই ভালো – রাত্রিবাস নম্বরে পরিনত হয়েছিলো। সে সবের কোন কিছুই মনে নেই।নানান রাজধানীর দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ভুলে গেছি। বিস্মৃত হয়েছি কোথায় কোন হোটেলে ছিলাম। মনে নেই কোন সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছি।

আসলে পৃথিবীর যেখানেই গেছি, সেখানেই সবচেয়ে বেশী আকর্ষিত হয়েছি মানুষের প্রতি। মস্কোর শেষ বিকেলের মেয়েটিকে মনে আছে, সিরিয়ার সেই শরনার্থী শিশুটির কথা ভুলি নি যে আলেপ্পো থেকে নিয়ে আসা তার ছেঁড়া পুতুলটি ছাড়বে না, মনের চোখে চীনের সেই ছেলে-মেয়ে দু’টোকে দেখতে পাই যারা মুখোমুখি দু’টে সাইকেলের হাতল ধরে তাদের ভালোবাসার যতি টানছিলো, মুষলধারে বর্ষার মধ্যে ইউক্রেনের যে মা নিজে ভিজে জবজবে হয়ে তিনটে বাচ্চাকে নিজের ছেঁড়া কোট দিয়ে রক্ষা করছিলো, তাঁর ছবি এখনও আমাকে তাড়া করে। আসলে স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই সব মানুষেরা যাঁদের সঙ্গে দেখা পথে-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে, অরন্যে-লোকালয়ে। মনের মধ্যে তাঁদের ‘নিত্য আনাগোনা’।

দেশে দেশে আমার দেখা নানান মানুষের কেউ কেউ আমার লেখায় উঠে এসেছে – কিন্তু লেখা হয় নি বহু মানুষের কথা। লন্ডনের এক মেমসাহেবের কথা এখন ও তো লিখে উঠতে পারি নি, লিখিনি মলদোভার সে তরুনী বধূটির কথা, যে পরম মমতায় যত্ন করে রাখে তাঁর পঙ্গু স্বামীটিকে, বাহরাইনের সে ডাক্তারটি কথা যে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ মাইল ঘুরে ঘুরে রোগী দেখে।লেখা হয় নি আয়ারল্যান্ডের সেই ঋষিতুল্য বৃদ্ধের কথা, যিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘গ্রন্থই আমার জীবন’, রুমানিয়ার সেই জিপসী নারীর কথা, যিনি দাবী করেছিলেন যে আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভাই, কিংবা দক্ষিন সুদানের সেই শিশুটির কথা, যে আমার চশমাটি চেয়েছিলো।এঁদের সবাইকে নিয়ে মনের মধ্যে এক ধরনের আর্তি আছে।লিখতে কি পারবো সবার কথা? কে জানে?

জানি, এ দীর্ঘ ভ্রমন-যাত্রায় যে সব জায়গায় গিয়েছি, সেখানেও আর যাওয়া হবে না। আর গেলেই বা কি? এক নদীতে যেমন দু’বার পা দে’য়া যায় না, এক শহরেও দু’বার যাওয়া যায় না।তারচেয়েও বড় কথা, এ পথ চলায় যাঁদের দেখা পেয়েছিলাম, দেখা হবে না তাঁদের কারো সঙ্গেই এ জীবনে।এ জীবনে কতজনের কাছে যে কত যে ঋণ – দিয়েছি যা, নিয়েছি তো তারচেয়ে অনেক বেশী।ও নিয়ে বেশী ভাবি না – জগতের সব ঋণ শুধবার নয়, আর তা শোধ করাও যায় না এক জীবনে।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199