বিদায়ী অভিবাদন, রাজনীতির শুদ্ধ ব্যক্তিত্ব অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 17 Oct 2024

2065 বার পড়া হয়েছে

Shoes
জ. ই মামুন
জ.ই মামুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুদ্ধ ব্যক্তিত্ব হাতে গোনা কয়েকজন। সৎ, ত্যাগী, প্রকৃত দেশপ্রেমী, নির্লোভ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ গড়ার জন্য যে ক’জন রাজনীতিবিদ সারা জীবন নিরলস কাজ করে গেছেন; ভিন্ন দলের, ভিন্ন মতের মানুষের মনেও শ্রদ্ধার আসন পেয়েছেন তাদের মধ্যে মতিয়া চৌধুরী অন্যতম। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই সৎ রাজনীতিবিদের উদাহরণ হতে পারে এমন একজন নেতাকে হারালো।

সাংবাদিকতা পেশার কারণে বহুবার মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, কিছুটা সৌহার্দ্যও হয়েছে। মায়ের বয়সী হলেও তাঁকে আমরা সাংবাদিকরা আপা ডাকতাম, মতিয়া আপা। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে তাঁকে হরতালে নেতাকর্মীদের সঙ্গে রাজপথে- মিছিলে দেখেছি, পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখেছি।

অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন মতিয়া চৌধুরী। কোনোদিন তার পরণে সুতি ছাড়া কোনো দামি শাড়ি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। গয়নাগাটির তো প্রশ্নই ওঠে না। ২০০৪-০৫ সালের দিকে, আমাদের এটিএন বাংলার নিউজ রুম তখন কারওয়ান বাজারের জালালাবাদ ভবনের তিন তলায়। তখন মাঝে মাঝে দেখতাম মতিয়া আপা হাতে একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে কারওয়ান বাজারের রাস্তায় হাঁটছেন আর আলু পটল লাল শাক কিনছেন। ৫/১০ টাকা দাম কমানোর জন্য তিনি দোকানীদের সঙ্গে দামাদামিও করতেন।

২০০৯ সালে মন্ত্রী হবার পরেও তাঁকে একই ভাবে কারওয়ান বাজারে দামাদামি করে বাজার করতে দেখেছি। পার্থক্য শুধু এই যে তখন বাজারের ব্যাগটা উনার নিজের হাতে না, থাকতো সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যের হাতে।

এত বছর মন্ত্রী ছিলেন, কখনো সরকারি বাড়িতে থাকেননি। উনার স্বামী, প্রখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমানের সিদ্ধেশ্বরীর চড়ুই পাখির বাসার মতো ফ্ল্যাটেই থাকতেন। বজলু ভাইয়ের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল একাই ওই বাসায় থাকতেন। একটা মাত্র বেড রুম, ড্রয়িং কাম ডাইনিং মিলিয়ে সাত আট শো স্কয়ার ফিটের বেশি হবে না। নেতা কর্মীদের তদ্বির তিনি কখনো শুনতেন না, তাই তাঁর বাড়িতে লোকজনের তেমন ভিড়ও থাকতো না। একবার তার বাসায় গিয়ে কি কাজে দেরি হয়ে গেলে তিনি ভাত খেতে বলেন। তিনি নিজ হাতে মূলা ভর্তা করে খাইয়েছিলেন। মূলা ভর্তা যে এত মজার হতে পারে তা আমি সেদিনই প্রথম জানলাম।

কয়েক বছর আগে একবার ছাত্রলীগের কি এক অপকর্ম নিয়ে পত্র পত্রিকায় খুব লেখালেখি হচ্ছিলো। তখন কোনো অনুষ্ঠানে মতিয়া আপার সঙ্গে দেখা, বললাম আপনি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসেন, আপনি তাকে কেন বলেন না ছাত্রলীগকে সামলাতে? তিনি হেসে যা বললেন তার মানে হলো, তিনি নিজে যেহেতু ছাত্রলীগ করেননি, (উনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, পরিবর্তীকালে আওয়ামী লাগে যোগ দেন) তাই ছাত্রলীগ নিয়ে কিছু বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী যদি এমন কিছু বলেন, যা শুনতে তার ভালো লাগবে না- এজন্য কখনো তিনি ছাত্রলীগ নিয়ে কোনো কথা বলতেন না।

লেখাটা শেষ করি এটিএন বাংলার একটা টক শো এর ঘটনা বলে। আমার সঞ্চালনায় সেই টক শোতে অতিথি ছিলেন সেই সময়ের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ব্র্যাকের তখনকার নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব হোসেন (এখন প্রয়াত)। আলাচনার মাঝে অনেক তর্ক বিতর্ক হলো, মতিয়া চৌধুরী এবং মির্জা ফখরুল নানা রাজনৈতিক বাহাস করলেন। লাইভ অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা যখন চা খেতে বসেছি, তখন মির্জা ফখরুল সাহেব মতিয়া চৌধুরীকে বললেন, “আপা কিছু মনে করবেন না, রাজনীতি করতে গেলে তো কত কথাই বলতে হয়, আমার কোনো কথায় মন খারাপ করবেন না। আপনাদের কাছ থেকেই তো রাজনীতি শিখেছি, সেই অর্থে আমি তো আপনার ছাত্র।” ফখরুল সাহেবের কথা শুনে মতিয়া আপা হেসে বললেন, “সবই বুঝি। কিছু মনে করিনি।”

মতিয়া আপা, আপনাকে বলা হয়নি- গত ৫ আগস্টের পরে আপনার কথা খুব মনে পড়ছিলো। আপনি অসুস্থ জানতাম, একবার দেখতে যাবো বলেও ভেবেছিলাম। কি জন্যে যেন আর যাওযা হলো না। খুব আফসোস হচ্ছে!, আর দেখা হবে না আপনার সঙ্গে। আপনার রাগী রাগী চেহারার আড়ালের মায়াবী-স্নেহমাখা মুখখানা আর দেখা হবে না কখনো!

তবে আমি নিশ্চিত; আমরা, আমাদের সন্তানরা এমনকি তাদের সম্তানরাও আপনাকে স্মরণে রাখবে, শ্রদ্ধায় রাখবে। আপনার নাম বলে মানুষ তার সন্তানকে শেখাবে, কি করে আদর্শ মানুষ হতে হয়, আদর্শ নেতা হতে হয়, অসাধারণ মানুষ হয়েও হয়েও কি করে নির্লোভ ও সাধারণ জীবন যাপন করতে হয়।

ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199