ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ২৯

সাগর চৌধুরী

লেখক, কলকাতা থেকে

প্রকাশ: 15 Sept 2022

2275 বার পড়া হয়েছে

Shoes

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।

ঊনত্রিশ.

অশোকদা ও আমি

বাঙালি পাঠকমাত্রেরই অতি প্রিয় একজন লেখক তাঁর একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন ‘স্মৃতি সততই সুখের’। আমাদের প্রায় সকলেই বইটি পড়েছি এবং বহুলাংশে লেখকের এই নামকরণের সঙ্গে একাত্মবোধও হয়তো করেছি। ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ মনে করলে স্মৃতিমেদুরতা আমাদের অনেককেই আচ্ছন্ন করে তোলে। তবে এটাও কিন্তু মেনে নিতেই হয় যে অতীত স্মৃতিচারণের মধ্যে সুখ আর দুঃখ দুইয়েরই মিশেল থাকে, কারণ দুটোই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অবিমিশ্র সুখ অথবা অবিমিশ্র দুঃখ, কোনোটাই মানবজীবনের একেবারে শেষ কথা নয়।

আমাদের শৈশবে স্কুলের পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রশ্নপত্রে রচনা লেখা ছিলো আবশ্যিক। আমার সমসাময়িকদের নিশ্চয় মনে আছে, রচনার বিষয়ের মধ্যে প্রায়ই থাকতো ‘তোমার জীবনের একজন স্মরণীয় ব্যক্তি’, ‘আ মেমোরেবল্ পার্সন ইন ইয়োর লাইফ’। আমরা সচরাচর নিজেদের মা-বাবা-কোন শিক্ষক এই ধরনের কাউকে নিয়ে রচনা লেখার চেষ্টা করতাম, ক্কচিৎ কখনও এঁদের বাইরে ব্যতিক্রমী কোন চরিত্রকে নিয়ে হয়তো।

স্কুলজীবনে এই রচনা লেখার সময় কাকে বা কাদের আশ্রয় করেছি তা এখন আর মনে নেই। তবে পরবর্তী জীবনের ‘স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’ হিসাবে কেবল একজন নয়, দু’জনের কথা আমি মনে করতে পারি। দু’জনের সঙ্গেই আমার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা বিদেশে, যদিও এঁরা দু’জনেই আমাদের দেশেরই লোক, এবং আমার জীবনে এঁদের আবির্ভাব মোটামুটি একই সময়কালের মধ্যে।

আমার জীবনের এই দুই স্মরণীয় ব্যক্তির একজন, অশোক গুপ্ত, আমাদের সবাইয়ের অতি প্রিয় মানুষ, পরম আত্মীয়, অভিভাবকতুল্য অশোক’দা ,ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন বছর দুই-আড়াই হলো। বিলেতবাসের সময়ে তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করার সুযোগ আমরা যারা পেয়েছি, তাদের মনে তো এই গুণী, স্নেহবৎসল মানুষটির সাহচর্যের কত স্মৃতি সঞ্চিত রয়েছে। তাঁর অবর্তমানে ঐসব স্মৃতি আমাদের মনকে দুঃখভারাক্রান্ত করে তুলবে প্রায়শঃই কারণ অশোকদা’র সঙ্গসুখ থেকে এখন আমরা চিরতরে বঞ্চিত। এই অভাববোধ এখন থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের সঙ্গী। আমি এবং আমার স্ত্রী ঊর্মি (রহমান) আজকাল আর বিলেতবাসী নই, অতিমারীর কারণে তিনচার বছর যাবৎ যেতেও পারছি না সে-দেশে। সেজন্য অশোকদা’র সঙ্গে শেষ সাক্ষাতও সম্ভব হয়নি, যেটা আর কখনো হবে না পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবার লন্ডন যেতে পারলেও। তাই অতীতের স্মৃতি যতই মনোরম হোক না কেন, তাঁর অনুপস্থিতি মনকে ভারী করে তুলবেই।

অশোক গুপ্ত তাঁর জীবনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী কাটিয়েছেন বিলেতে এবং এই সময়টার কমপক্ষে অর্ধেকটা তিনি ছিলেন পূর্ব লন্ডনের ব্রিক্ লেন এলাকার বাসিন্দা। এই রাস্তাটিতে অথবা তার আশেপাশের শোরডিচ্, স্পিটালফিল্ডস্, হোয়াইটচ্যাপেল, বেথনাল গ্রীন ইত্যাদি প্রতিবেশী এলাকায় ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নেইবারহুড’, এমন কোন পুরানো লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, বাঙালি বা ইংরেজ-অইংরেজ নির্বিশেষে, যিনি অশোক গুপ্তকে চিনতেন না বা সমাদর করতেন না। দেশ ছেড়ে বিদেশে আসায় এবং সেখানে দীর্ঘকাল বসবাস করায় কিন্তু প্রথম জীবনে অশোক’দা মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার আগে তিনি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সংবাদপত্র গোষ্ঠির তৎকালীন কর্ণধার অশোক সরকার মহাশয়ের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি, তাঁদের দু’জনের নামের সাযুজ্য হয়তো এর একটা কারণ ছিলো। সে যাই হোক, শুনেছি এক দিন অশোকবাবু তাঁর সমনামা যুবকটিকে ডেকে বললেন, ‘শোনো, অশোক, তোমাকে তো লন্ডনে পাঠাবো স্থির করেছি আমরা।’ আমাদের অশোক’দা নাকি চমকে উঠে বলেছিলেন, ‘সে কী! লন্ডন? না না, কলকাতা ছেড়ে লন্ডন যেতে পারবো না আমি।’ অশোকবাবু প্রবোধ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আহা, ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন? যাও না তিন-চার বছরের জন্য। আমাদের ব্যুরো চীফের একজন যোগ্য সহযোগী দরকার। তাঁর সঙ্গে মিলে ওখানকার সেট্-আপ্ একটু গুছিয়ে দাও, তার পর তোমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনবো আবার।’ কী আর করবেন অশোক’দা, বড়কর্তার কথার ওপরে তো আর কথা চলে না, অগ্যতা লন্ডনে আসতে নিমরাজি হয়ে গেলেন। সেটা ১৯৫৬ সাল। সেই যে এলেন, থেকে গেলেন বিলেতে তথা লন্ডনেই, আমৃত্যু। বিয়ে করলেন দেশ থেকে আসা বঙ্গললনাকে, পুত্রসন্তানের জনক হলেন বছর কয়েক পর, অর্থাৎ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে শুরু করলেন। কলকাতায় ফিরে যাওয়া আর হলো না কোনদিন। তার মানে অবশ্য এই নয় যে সুদীর্ঘ ছয় দশকাধিক কালে একবারও কলকাতায় আসেননি। আসা-যাওয়া করেছেন মাঝেমধ্যেই, গোড়ার দিকে কর্মসূত্রে, পরবর্তীকালে হয়তো আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে, তবে খুব ঘন ঘন নয়। ঊর্মি আর আমি কলকাতা-নিবাসী হওয়ার পরেও একবার এসেছিলেন, দু’টি বা তিনটি সন্ধ্যা জমিয়ে আড্ডা দিয়েছি আমরা।

আশি’র দশকের মাঝামাঝি আমি নিজে লন্ডনে যাওয়ার মাস চারেক পর অশোকদা’র সঙ্গে আমার পরিচয়। সম্ভবত বিবিসি বাংলা বিভাগে আমার কোন সহকর্মীর মাধ্যমে। ততদিনে তিনি আনন্দবাজার গোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছেন। ব্রিক্ লেন-এ একটা ভাড়াবাড়িতে থাকেন এবং ঐ বাড়িতেই অফিস করেছেন, কয়েকজন সুযোগ্য সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে ডিজাইন, টাইপসেটিং, প্রিন্টিংএর কাজ করার জন্য। মনে আছে, অশোকদা’র অফিসেই বোধ হয় আমি কম্পিউটারে বাংলা টাইপসেটিং-এর কাজ প্রথমবার দেখি। আমার বিশ্বাস, লন্ডনে বাংলা মুদ্রন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে অশোক’দা একমাত্র না হলেও অন্যতম পথিকৃৎ তো নিশ্চয়ই। কম্পিউটার ব্যবহার আমার নিজের রপ্ত হতে আরো বেশ কিছু দিন লেগেছিলো। সেদিন ওঁর অফিসে যখন যাই তখন বেলা দ্বিপ্রহর প্রায়। দেখলাম স্যুট-টাই পরিহিত স্মার্ট চেহারার একজন কেজো মানুষ। পরে অশোক’দাই বলেছেন এই ধরনের ‘ফর্মাল’ সাজসজ্জা না করে তিনি সচরাচর কাজে বসতেন না, অফিস বাড়িরই এ’ঘর থেকে ও’ঘর হওয়া সত্ত্বেও। ঐ দিনের পর থেকে অবশ্য তাঁর আটপৌরে, ঢিলেঢালা চেহারা আর বৈঠকী মেজাজের সঙ্গে ক্রমে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম।

এর বেশ কয়েক বছর পর, যখন অশোক’’দা তাঁর নিয়মিত কর্মব্যস্ত জীবন থেকে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাবসর নিচ্ছেন তখন, স্থানীয় কাউন্সিল (পৌর কর্তৃপক্ষ) থেকে তাঁর জন্য একটা ছোট একতলার ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়। ব্রিক্ লেন ঘেঁষা স্পেলম্যান স্ট্রীটের এই ফ্ল্যাটেই তিনি তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঊর্মি, আমি এবং অশোকদা’র অনুরাগী আমাদের আরো কয়েকজন বন্ধু এই ফ্ল্যাটেই যেতাম তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে। নিজের হাতে চর্বচোষ্য রেঁধে সবাইকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। প্রচুর রান্না করতেন, পরিমাণ দেখেই মনে হতো নিছক অপচয়। এই নিয়ে আমরা কখনো অনুযোগ করলে অশোকদা’র একটাই জবাব ছিলো, ‘যা পারো খাও তো এখন, আর যা বাকি থাকবে বাড়ি নিয়ে যাবে, সেখানে খাবে।’ তাঁর এই স স্নেহ নির্দেশ কখনো-সখনো মেনেও নিয়েছি আমরা।

প্রচুর পড়াশোনা করা, শিক্ষিত, উদারমনা, বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। পত্নী বিয়োগের পর থেকে কিছুটা নিঃসঙ্গও বটে, বিশেষ করে একমাত্র পুত্র ইংল্যান্ডের বাইরে ইয়োরোপের অন্যত্র বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেও। তাই আমাদের মতো বন্ধুবান্ধব পরিবৃত হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। আমাদের কাছেও তাঁর সান্নিধ্য অত্যন্ত উপভোগ্য ছিলো। মনে আছে, যখনই অশোকদা’র সঙ্গে দেখা হতো আমি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম। অশোক’দা সব সময় বলতেন, ‘প্রত্যেকবার পায়ে হাত দিস কেন?’ আমি উত্তর দিতাম, ‘তোমার মতো মানুষের পাদস্পর্শ করলে মন পরিতৃপ্ত হয়।’ সেই মানুষটির সঙ্গে আর কোন দিন দেখা হবে না, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে জীবনে এমন যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা তো আর পূরণ হওয়ার নয়। (চলবে)

ছবি: লেখক ও গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199