অর্থহীন ভাবনার ভেতর দিয়েই কখনও কখনও বেরিয়ে আসতো মূল ভাবনা

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 27 Jun 2024

2595 বার পড়া হয়েছে

Shoes
রফি-হক
রফি হক

একটা বয়স ছিলো— সতেরো, আঠারো, ঊনিশ— কী অস্থির ছিলাম ! কেবল ঢাকাতে থিতু হতে চেষ্টা করছি । ক্লাসে মন দিতে চেষ্টা করছি । কিন্তু মন বড় চঞ্চল । মন ভালো লাগছে না— ক্লাস থেকে বেরিয়ে ইকো আর আমি বেইলি রোডে চলে যাই ‘প্রিন্স’ নামে একটি কনফেকশনারী হয়েছে সেখানে । আমার খুব প্রিয় ছিল চিকেন প্যাটিস আর কোকাকোলা । কোমর বাঁকানো কাঁচের বোতলের কর্ক খুলে বোতলটি মুখে লাগিয়ে এক নি:শ্বাসে ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে ফেলতাম ! পর পর দুটি কোক খেতাম । কী প্রশান্তি ! আহ্ ! বেইলি রোডের দুপুরগুলো নির্জন থাকতো ।

তখন ঢাকাতে তেমন আধুনিক কনফেকশনারী ছিলো না । একটি কলাবাগানে ছিলো— ‘সোরেন্টো’ । সোরেন্টোর মালিক ছিলেন এক জার্মান দম্পতি । সেরেন্টোর ফ্রুট টার্ট, প্যাটিস অতুলনীয় ছিলো । আমি কনফেকশনারীতে আজ পর্যন্ত বার্গার খাইনি । খেতে ইচ্ছেও করেনি । কেন জানি রুচি হতো না । গুলশান এক নং ডিসিসি মার্কেটে হোসেন কনফেকশনারির চিকেন প্যাটিস ছিলো দুর্দান্ত। হোসেন কনফেকশনারি বোধহয় এখনও আছে। তবে ওই চিকেন প্যাটিস পাওয়া যায় না। গুলশান দুই নং ডিসিসি মার্কেটে একটি ভালো কনফেকশনারি ছিলো। ওখান থেকে আমি ব্রেড নিতাম। কেকও নিতাম। ওই দোকানের রুটি ঢাকার বিদেশি নাগরিকেরাও নিতো। বেকারিটি উঠে গেছে। ওখানে এখন ফার্মেসি হয়েছে।

…প্রেমিক প্রেমিকাদের নিরিবিলি কোনো বসার জায়গা ছিলো না । এদিক সেদিক কোনো কফি হাউজ টাউজও ছিলো না । শাহবাগে সিনোরিটা, মৌলি, কোহিনূর ছিলো । সে তো লোকে ঠাসা থাকতো । শাহাবাগ থেকে ফার্মগেট পেরুলেই শহর পাতলা হতে থাকতো । জাহাঙ্গীর গেট পার হয়ে কাকলী, বনানী, ডিওএচএস, ঢাকা গেট— তার পর ঢাকা শেষ !

এই সময়টা আমার চাঁদের হাটের সময়। প্রতি সপ্তাহে চাঁদের হাটের সাহিত্যসভা হতো। আমার  বন্ধু শায়লা রহমান লিপির দায়িত্ব ছিলো সেটা আয়োজন করার। মতিঝিল 'টয়েটা' বিল্ডিংয়ের পাশে অবজারভার, চিত্রালী ভবনে আমাদের সাহিত্য সভা হতো। খুব প্রাণবন্ত ছিলো সেই সাহিত্য সভাগুলো।

... আমার প্রচন্ড পড়ার নেশা ছিলো। প্রতিদিন পড়তাম । আর্ট কলেজের লাইব্রেরিতে । আর্ট কলেজের লাইব্রেরিতে তখন হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্র পড়ালেখা করতো । তবে আর্ট সংক্রান্ত বইপত্র ছাড়াও লাইব্রেরিতে ছিলো প্রচুর কবিতা, গল্প, ছড়ার বই । একমাত্র আমিই বোধহয় সেই বইগুলোর পাঠক ছিলাম— রোজ অন্তত একটা ভালো লাইন পড়তে না পারলে মন খারাপ হতো । বৃথা মনে হতো দিনটা । কবিতার লাইনগুলো গুন্গুন্ করতো রক্তের মধ্যে সারাক্ষণ— মিশে থাকত আমার অনুভবে ।

কোনো প্রেমে পড়িনি তখনো— কিন্তু প্রেমের ভালো লাগাটা মন ছুঁয়ে যেতো । মনে মনে অনুভব করতাম, আনন্দ হতো, কষ্টও হতো । একজন আর্মি অফিসারের কন্যা দুপুর গড়িয়ে গেলে আমাকে নিয়ম করে টেলিফোন করতো, অফিসে । সে কখনও ‘ভালোবাসি’ এই কথাটি বলেনি । ঐ বিশেষ শব্দটি আমি খুব শুনতে চেয়েছিলাম তার কাছ থেকে, আর ভাবতাম একবার অন্তত বলুক ।… তবু তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাকে না ছুঁয়েও, দূরে থেকেও তার কত কাছে যাওয়া যায় তার একটি চিত্রকল্প তৈরি করতাম মনে মনে । এই সূক্ষ্ম কল্পনার খেলাটি খেলতে খেলতে তাকে বোঝাতাম জীবনানন্দের কবিতা । কবিতা কি নিজেও বুঝতাম ? কবিতা বোঝানোটা একটা ছল ছিলো মাত্র । কথার পর কথা সাজিয়ে যেতো মেয়েটি । মুগ্ধ হয়ে শুনতাম ওর কণ্ঠ । অভিমান হলে নীরবতা বয়ে যেত পেচানো তারের ভেতরে দিয়ে । তখনকার টিএন্ডটি ফোনগুলো খুব নিরীহ ছিল । সেই অল্প বয়সে অভিমানের নীরবতা ছিল বর্ষার দোপাটির মতো নরম অথচ সতেজ ।

সেই মধুর কষ্ট আমি বয়ে নিয়ে আসতাম— হস্টেলের নি:সঙ্গ শয্যায়, ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া শেষ রাত্রে, বালিশে মুখ গুঁজে ভাববার জন্যে, কষ্ট নিয়ে খেলা করবার জন্য, ছবি আঁকবার জন্য । এ যেন ক্যানভাসে ছবি চাপানোর আগে ঘোর আচ্ছন্ন কোনো মুহূর্ত ! কিন্তু সেই অর্থহীন ভাবনার ভেতর দিয়েই কখনও কখনও বেরিয়ে আসতো মূল ভাবনার স্ফূরণ । একটি নতুন পেইন্টিংয়ের বীজ !

ছবি:গুগল ও লেখকের ফেইসবুক থেকে

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199