কোথায় যাচ্ছেন এলোমেলো বাবু

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 21 Nov 2024

2915 বার পড়া হয়েছে

Shoes
স্বরূপ জাহিদ

সেদিন সদ‍্য কৈশোর পেরুনো এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো। ইদানীং যাদের আমরা জেন জি বলি। এদের নিয়ে আমার আগ্রহের সীমা নাই। কারন আমার নিজের ছেলেও এদের দলে । আমি এদের চোখে চোখ রাখি। চোখের দ‍্যুতি বোঝার চেষ্টা করি । হৃদয়ের কম্পন ধরার চেষ্টা করি। জুলাই থেকে কাজটা আরো বেশী করি। অদম‍্য এই প্রজন্ম একটা দেশের রাজনৈতিক গতিপথ বদলে দিলো। দেশকে গনতন্ত্র ফিরিয়ে দেবার চেষ্টায় বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিলো। রক্তাক্ত হলো প্রজন্মের সুর্য় সন্তানরা। অর্ধ শতাব্দী পেরুনো আমাদের দেশে এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ‍্যায়।

তো শুরুতে যে ছেলেটার কথা বলছিলাম। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, দেশ নিয়ে এখন সে কি ভাবছে ? এখানে বলে রাখি, জুলাই আন্দোলনে সে সক্রিয় একজন যোদ্ধা। বৈষম‍্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সেও মাঠে ছিলো। আমি যখন তাকে প্রশ্নটা করলাম, কেনো যেনো মনে হলো হঠাৎ এক পলকের জন‍্যে একটু হলেও বিষাদ দেখলাম তার চোখের তারায়। সে বলছিলো , “ আংকেল দেশ নিয়ে ভাবনা আছে। কিন্তু জানেন, রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি না। ভয়ংকর দুস্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠি। গুলি, রক্ত, মরদেহ আর পুলিশের পোশাক এখনো ঘুমের মধ‍্যে তাড়া করে। পড়াশোনা হচ্ছে না। বন্ধুদের আড্ডা ভালো লাগে না। সিনেমা ভালো লাগে না। এমনকি বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। সব এলোমেলো হয়ে গেছে।”

এই যে একটা প্রজন্মের এলোমেলো জীবন, সেটা নিয়ে রাস্ট্র কি আদৌ ভাবছে ? খেয়াল করে দেখবেন, যারা জুলাই আন্দোলনে মাঠে ছিলো, তাদের অনেকেই জুলাই অগাস্টের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যার প্রভাব পড়ছে তাদের যাপিত জীবনে। উদাহরন দিই। আমি নিয়মিত মেট্রো রেলে ভ্রমন করি। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন আমার গন্তব‍্য, তাই সকালে এক ঝাঁক জেন জির সংগে আমাকে ভ্রমন করতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই তাদের গল্প আমার কানে আসে। এরা হয়তো সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নয়। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের । মোটাদাগে সবার গল্প প্রায় এক। বিষয় গুলো এরকম, রাতে ঘুম হয় নাই, পরীক্ষা দিতে পারবো না, লাস্ট ৪ টা ক্লাস মিস দিসি, পকেটে টাকা নাই, আতিফ আসলামের কনসার্টের টিকিট কেনার টাকা নাই। মনে হতেই পারে এগুলা খুবই সাধারন সমস‍্যা। আমাদের জেনারেশনেও এসব সমস‍্যা ছিলো। কিন্তু পার্থক‍্যটা কোথায় ? আমি অবাক হই যখন তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখি। এই অস্থিরতা আমি জুলাইয়ের আগে দেখিনি। আমি ওদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা দেখি। আমি ওদের চোখে বিষাদ ভর করতে দেখি। সত‍্যি বলতে কি, জুলাইয়ের আগের প্রাণচঞ্চলতা তাদের মাঝে একেবারেই নেই।

দেশে সময়টা খুব বেশী এলোমেলো। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর চারপাশে অস্থিরতা । কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। একটা প্রতিশোধ, একটা ক্রোধ সবাইকে অস্থির করে তুলেছে। দেশের বিচারিক ব‍্যবস্থার উপর আস্থা রাখলে কিন্তু এই অস্থিরতা থাকার কথা নয়। বহুদিনের বঞ্চনা, শোষন বা পুঞ্জীভূত ক্রোধ এই অস্থিরতা প্রতিনিয়ত জন্ম দিচ্ছে। অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। দেশের বিচার ব‍্যাবস্থায় প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হবে, সেটাই ছিলো কাম‍্য। আর তাতে সবার আস্থা থাকবে। অথচ বাস্তবতা হলো, আন্দোলন থামছে না, ক্রোধ থামছে না, মব জাস্টিস থামছে না, বাতিলকরন থামছে না, অস্বীকার করা থামছে না, ইতিহাসকে উপহাস করা থামছে না, এমনকি সিন্ডিকেটের অত‍্যাচারটাও থামছে না। আনসার, গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে ব‍্যাটারী রিক্সার চালক সবাই ন‍্যায‍্য হিস‍্যা চায়। অস্থিরতার এই যে একটা চরম অবস্থা , এটার চাপ পরোক্ষভাবে কিন্তু জেন জি প্রজন্মের উপর পড়ছে। কারন জুলাই আন্দোলনের প্রধানতম অংশ তারাই। বেশ কয়েকজন জেন জি বা জুলাই যোদ্ধা ছাত্রের ভাষ‍্য, আমরা একটা শান্তিপূর্ণ দেশ চেয়েছিলাম যেখানে আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধা থাকবে। এরকম ঔদ্ধত্যপুর্ন এলোমেলো সময় আমরা চাইনি।

সরকারের একশোদিন পূর্ণ হলো এ সপ্তাহে। সময়টা কিন্তু এলোমেলোই গেলো। পিছনে ফিরে তাকালে সবচাইতে বড়ো যে ক্ষতিটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো, আমরা একটা প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের বড়ো ক্ষতি করে ফেলেছি। জেন জি নিয়ে আমাদের উচ্ছাসের কমতি নেই। জুলাই আন্দোলনের পুরোধা এই প্রজন্মই কিন্তু পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দী দেশ কে নেতৃত্ব দিবে। অথচ জুলাই আন্দোলনে দেশের আনাচে কানাচে এই প্রজন্ম যে ভয়াবহ ট্রমার মধ‍্য দিয়ে গেছে, যে পরিমান মানসিক ভয়বহতা তাদের গ্রাস করেছিলো  তার মেরামত কি আমরা করতে পেরেছি? দেশে অনেক মনোবিজ্ঞানী আছেন, মানসিক চিকিৎসক আছেন। কতোজন অভিভাবক তার জেন জি সন্তানকে নিয়ে গেছেন চিকিৎসকের কাছে। চোখের সামনে বন্ধু, সহযোদ্ধার রক্ত দেখা এই প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের খবর আমরা কতোটুকু রেখেছি। অবশ‍্য যেখানে জুলাই আন্দোলনে মারাত্মক আহত জেন জি দের নুন‍্যতম চিকিৎসাই অপ্রতুল, সেখানে শারিরীকভাবে সুস্থদের মানসিক স্বাস্থ্যের  খবর নেয়াটা হয়তো বিলাসিতা।

জেন জি দের আচরন কি আপনার এলোমেলো লাগছে? দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রজন্মের হাতে দেশের ভার দিতে চাইলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের খবর নিন। তারা ঠিকমতো রাতে ঘুমাতে পারছে কিনা খোঁজ নিন। এলোমেলো সময়ে তাদের আর এলোমেলো হতে দিবেন না। তাদের আনন্দময় ভবিষ‍্যত আমাদের হাতে। ভাবুন। তাদের নিয়ে একবার ভাবুন।

ছবি: গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199