চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়…

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 19 Dec 2024

3870 বার পড়া হয়েছে

Shoes
ফারুক-মঈনউদ্দীন
ফারুক মঈনউদ্দীন

আশির দশকের গোড়ার কথা। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গন্ডী পার হইনি। কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে গল্প লিখছি তখন। 'দৈনিক বাংলা' আর 'ইত্তেফাক'এর সাহিত্য সাময়িকীতে গল্প-টল্প ছাপাও হচ্ছে। 'দৈনিক বাংলা'য় কয়েকটা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এই দু’টো পত্রিকা বাদ দিলে 'সংবাদ' ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য জাতীয় দৈনিক ছিলো না তখন। 'দৈনিক বাংলা'র সাহিত্য পাতা দেখতেন কবি আহসান হাবীব, আর 'ইত্তেফাক'এরটা দেখতেন আল মুজাহিদী। তবে সমসাময়িক সাহিত্য সম্পাদকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম আহসান হাবীব ছিলেন তরুণ লেখকদের সবচেয়ে কাছের মানুষ। এখানে স্বীকার না করলে অন্যায় হবে, মূলতঃ তাঁর হাত ধরেই লেখালেখির জগতে ঢোকার রাস্তাটি মসৃণ হয়েছিলো আমার। আরেকটি পত্রিকা ছিলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মুখপত্র 'দৈনিক দেশ।' তখন লেখা ছাপাবার মতো কাগজ বেশি না থাকলেও একটি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র ছিলো বলে এই কাগজটিতে লেখা দেওয়ার কথা কখনোই মনে আসেনি। এটির সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করতেন কবি হেলাল হাফিজ । একবার চট্টগ্রাম থেকে কবি আসাদ মান্নান ঢাকায় এলে আমাকে নিয়ে হেলাল ভাইয়ের অফিসে গিয়েছিলেন, নিছক আড্ডা দেওয়ার জন্য। তুমুল জনপ্রিয় এই কবির সঙ্গে সেখানেই প্রথম পরিচয়। তাঁর বহু কবিতার পঙক্তি তখন অনেকের মুখে মুখে ফিরতো। 'এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ' সময়ের ইঙ্গিত বোধকরি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা দিয়েছিলো তাঁকে। পরিচিতির এক পর্যায়ে আসাদ মান্নান হেলাল ভাইকে জানান যে গল্প আমি লিখি। কথাটা শুনে তক্ষুনি কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। সত্যি বলতে, এই কাগজে লিখার ইচ্ছে না থাকলেও তাঁর নিরাসক্ত ভাবের কারণে মনে মনে কিছুটা দমে গিয়েছিলাম। আমরা বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় হেলাল ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ আন্তরিক গলায় বললেন, 'আমাকে লেখা দিয়ো।' দলীয় মুখপাত্র বলে হয়তো লেখার অভাবও ছিলো তাঁর, তা নাহলে আমার মতো অখ্যাত একজনের কাছ থেকে গুরুত্ব দিয়ে লেখা চাইবেন কেন তিনি? পরিপাটি সিঁথি করে আঁচড়ানো ঘাড় অবধি লম্বা চুলের প্রিয় এই কবির সত্যিকারের আন্তরিক অনুরোধ ফেলতে পারিনি। তাই পরের লেখা গল্প দিয়েছিলাম তাঁকে। বেশ যত্ন করেই সেটা ছেপেছিলেন তিনি। তার পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে রোকেয়া হলের উল্টোপাশে হাকিম চত্বর সংলগ্ন লাইব্রেরির গেটে হেলাল ভাইর সঙ্গে আচমকা দেখা। এসময় লাইব্রেরির পেছনে হাওলাদারের ক্যান্টিন ছাড়াও হাকিম চত্বরের ঘাসের বিছানা ছিলো আমাদের আড্ডার আরেকটা জায়গা। তিনি বললেন, 'তোমাকেই মনে মনে খুঁজতেছিলাম।' ভাবলাম, বলার জন্যই বলছেন তিনি। তারপর আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে বলেন, 'তুমি মহসিন হলের ৬৬০ নম্বরে থাক না'? বিস্ময় গোপন না করেই বলি, 'হ্যাঁ, আপনার মনে আছে?' তিনি তাঁর পরিষ্কার খরখরে গলায় বললেন, 'মনে রাখতে হয়। তোমাকে খুঁজতেছিলাম একটা গল্প দেওয়ার জন্য। প্রচুর উপমা দিয়া একটা গল্প দিবা আমাকে। অই যে আগের গল্পটাতে লিখছিলা, শাহবাগের একটা নিওন বাতি বার বার চোখ টিপছে বখাটে ছেলেদের মতো।' দ্বিতীয়বারের মতো আমার অবাক হওয়ার পালা। বললেন, 'এইরকম প্রচুর উপমা দিয়া লিখবা গল্পটা।' তা দিয়েছিলাম একটা গল্প। সেটাতে অনেক উপমার মধ্যে একটার কথা মনে আছে। একটা মেয়ের বর্ণনায় লিখেছিলাম, 'ওর গলায় রূপোর একটা হার ঘন অরণ্যের ভেতর বাঁক নিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মতো হারিয়ে গেছে খোলা চুলের ভেতর।' আরেকটা উপমার কথা মনে আছে। দ্রুতগামী চলন্ত বাস বা ট্রেন থেকে দেখা যাওয়া বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত বা মাঠের কাছের অংশের পেছনে সরে যাওয়া আর দূরের অংশের সাথে সাথে চলার মাঝামাঝি জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে মনে হয় যেন মাঠটা ঘুরছে। সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলাম, 'বাসের বাইরের বিস্তীর্ণ মাঠ ঘুরছে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ডের মতো।' তার পর কয়েক বছর কেটে গেছে। ব্যাংকের চাকরি নিয়ে খুলনা চলে গেছি। পঁচাশি সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিন সপ্তাহের ট্রেনিংয়ে ঢাকায় আসতে হয়। তখনকার ছিমছাম ভীড়ভাট্টাহীন বইমেলায় হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। জেনে নিলেন ক’দিন থাকবো ঢাকায়, তার পর বললেন, 'যাওয়ার আগে একটা গল্প দিয়ে যাবা।' তখন গল্প খুব বেশি লিখছিলাম না, তাই তাঁর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কবুল করলাম। কয়েকদিন পর আবার মেলাতেই দেখা হলে গল্প দিয়ে যাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তৃতীয়বারের মতো দেখা হলে বললেন, 'এখনো লেখা শেষ হয় নাই?' বুঝলাম এবার নিষ্কৃতি নেই। তাই যাওয়ার আগে একটা গল্প লিখে দিতেই হলো। সাহিত্য সম্পাদক এমন নাছোড় হলেই উদ্দিষ্ট কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারেন। বহু বছর গল্প লেখায় বিরতি দেওয়ার পর এরকম আরেকজন নাছোড় সম্পাদক পেয়েছিলাম, 'সাপ্তাহিক ২০০০'এর মঈনুল আহসান সাবের। আমার বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য গল্প লেখা হয়েছিলো তাঁরই তাগাদায়। তা না হলে সেগুলো হয়তো কখনোই লেখা হতো না। একবার তাগাদা দেওয়ার পর গল্প দিতে দেরি করায় হুমকি দিয়ে (একজন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রচুর অখাদ্য গল্প লেখকের নাম উল্লেখ করে) বলেছিলেন, 'গল্প না দিলে অমুকের গল্প তোমার নামে ছেপে দেবো কিন্তু।' হেলাল ভাইর সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারের অনুষ্ঠানে। শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন ততদিনে। একই টেবিলে বসেছিলাম আমরা। তাঁর স্নেহ টের পেয়েছিলাম যখন সদ্য পাওয়া উত্তরীয়টা আমাকে দিয়ে দিতে চাইলেন। বহু বুঝিয়ে নিরস্ত করতে হয়েছিলো তাঁকে। দীর্ঘ রোগভোগের পর যৌবনের একাকী কবি আজ চলে গেলেন। জানতেন চলে যেতে হবে, এভাবে নিঃসঙ্গ যাবেন সেটাও বোধকরি জানতেন। তাই বহু আগেই লিখে রেখেছিলেন: "কেউ কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয় অবলীলাক্রমে কেউ বেছে নেয় পৃথক প্লাবন, কেউ কেউ এইভাবে চলে যায় বুকে নিয়ে ব্যাকুল আগুন।" পরপারে অনেক ভালো থাকবেন হেলাল ভাই। বিশ্বাস করুন, 'চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়…।'

ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199