নকীব খান : সুরে ও গানে ৫২ বছর

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 16 Jan 2025

4685 বার পড়া হয়েছে

Shoes
শাহরিয়ার আদনান শান্তনু
শাহরিয়ার আদনান শান্তনু 

"মন শুধু মন ছুঁয়েছে

ও সেতো মুখ খুলেনি

সুর শুধু সুর তুলেছে 

ভাষা তো দেয়নি".....

বাংলাদেশের ব্যান্ড  সংগীতের ভুবনে একটি অতি জনপ্রিয় গান। আজ ৪৭ বছর ধরে সমান জনপ্রিয়। আজও একই আবেগে ও আবেদনে গানটি গেয়ে চলেছেন শিল্পীরা। গানটির গীতিকার নকীব খান। সুরকার জিলু খান। কিভাবে সৃষ্টি হলো এই জনপ্রিয় গান - জানতে চাইলাম নকীব ভাইয়ের কাছে। তিনি জানালেন: "১৯৭৮ সাল। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। বড় ভাই জিলু খান একদিন একটি সুর গুনগুন করছিলেন। শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। আমি  ওই সুরে প্রথম চারলাইন লিখি। পরে বড়ভাইকে দেখালাম। উনি তা দেখে খুবই খুশী হলেন। বললেন: খুব সুন্দর হয়েছে। এসো, আজই গানটি শেষ করে ফেলি। এভাবেই সেইদিনই গানটি তৈরি হয়ে গেলো। " পরে সোলস ব্যান্ডের মূল গায়ক তপন চৌধুরী গানটি গাইলেন। বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড  অডিও ক্যাসেট "সুপার সোলস"-এ রিলিজের পর তুমুল জনপ্রিয় হয়। সেই জনপ্রিয়তা আজও তেমনি আছে। বাংলাদেশের ব্যান্ড  সংগীতের ইতিহাসে এ এক বিস্ময়কর।

গানে ও সুরের আবহে বেড়ে উঠা....

নকীব খানের বাবা মরহুম আইয়ুব খান। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিজে একজন সংগীতপ্রেমী মানুষ। শখে গান গাইতেন তিনি। তাই নকীব খান পারিবারিক আবহে গানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন শৈশব থেকেই। তাঁর নানা কবীর খান সিদ্দিকী ছিলেন কাওয়ালী গায়ক। কোলকাতা থেকে নানার গাওয়া এলপি প্রকাশিত হয়েছিলো। পরবর্তীতে এই পরিবারের তিন সন্তান জিলু খান, নকীব খান,  পিলু খান - সংগীত শিল্পী হয়ে নিজেদের গড়ে তোলার পরিবেশ পেয়ে যান। তারই সূত্র ধরে জিলু খানই প্রথম গড়লেন একটি ব্যান্ড  - "বালার্ক"। স্বাধীনতা উত্তরকালে চট্টগ্রামে "বালার্ক" দারুণ সাড়া জাগিয়েছিলো। প্রবাল চৌধুরী, উমা ইসলাম প্রমুখ শিল্পীরা গান গাইতেন। সুর করতেন জিলু খান। এভাবেই স্কুল পড়াকালীন সময় থেকেই নকীব খান গান গাওয়া, বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে উঠলেন। একোডিয়ান বাজানো শিখলেন নকীব খান এবং বালার্ক ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন। এভাবেই স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই নকীব খানের সংগীত জীবন শুরু। সালটা তখন ১৯৭৩।

সোলস 

বড় ভাই জিলু খান ঢাকাবাসী হলেন। "বালার্ক" বন্ধ হয়ে গেলো। পরে নকীব খান যোগ দিলেন সোলস-এ। দীর্ঘ দশবছর সোলস-এর সঙ্গে যুক্ত থেকে অনন্য গৌরবময় সংগীত জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন। নকীব খান সোলস ব্যান্ডে যুক্ত হওয়ার পর সোলস মৌলিক গান গাইতে শুরু করে। নকীব খানের সুরে সোলস নিজস্ব ধারায় এগিয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সোলস এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করে। সেরা কীবোর্ড বাদক হন নকীব খান। এবং তাঁর সুরের গান সেরা গান হিসেবে পুরস্কৃত হয়। "সুপার সোলস " ক্যাসেট রিলিজের পর সোলস-এর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। পরবর্তীতে ব্যান্ড মিউজিকে একজন সুরকার, কীবোর্ড বাদক এবং গায়ক হিসেবে নকীব খান খ্যাতি অর্জন করেন। ওই সময়ের তাঁর সুর করা আরেকটি গান আজও সমান জনপ্রিয়। গানটি হলো আবদুল্লাহ আল মামুনের লেখায় " এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে "।

সৈকতচারী....

১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে কয়্যার ভিত্তিক সংগীত দল "সৈকতচারী"। দশজন পুরুষ ও দশজন মহিলা শিল্পী নিয়ে গড়া এই "সৈকতচারী" গানের দলটি ব্যাপক সাড়া জাগায়। সোলস-এর সদস্যরা এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মহিলা শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন কাকলী দেওয়ান, রুমী বড়ুয়া, কেরিন সাত্তার, মিতা চৌধুরী, আল্পনা চৌধুরী, সোহানা সিদ্দিকী, রুমানা,  রোখসানা সাফা, হাসিনা আহমেদ সোমাসহ বেশ কয়েকজন শিল্পী। ১৯৮০ সালে "সৈকতচারী" দলটি ওস্তাদ কিরীট খানের আমন্ত্রণে কোলকাতা গিয়েছিলো। এবং বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত নায়িকা সুচিত্রা সেনের বাসায় গিয়ে তাঁকে গান শুনিয়ে এসেছে। এই বিষয়ে নকীব খান স্মৃতিচারণে বলেন, "সুচিত্রা সেনকে আমরা গান শোনাতে পেরেছি এটা আমাদের জন্য পরম পাওয়া। তবে তিনি আমাদের সামনে আসেননি। তিনি আলাদা কক্ষে ছিলেন। পাশের কক্ষে আমরা গান পরিবেশন করি। উনার বাসায় যাওয়ার সময় শর্ত ছিলো কোন ক্যামেরা নেয়া যাবে না। তাই আমাদের আর ছবি তোলা হয়নি।"

রেনেসাঁ.... 

নকীব খান ঢাকাবাসী হলেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ এবং চাকুরী সূত্রে। সোলস ছেড়ে দিতে হলো। বেশ কিছুদিন ঢাকায় চলচ্চিত্র সংগীত জগতে কিবোর্ড বাদক হিসেবে কাজ করেন। পরে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরীতে যোগ দেন। তখন ছোট ভাই পিলু খানসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে গড়লেন ব্যান্ড  "রেনেসাঁ"।  বাংলাদেশের ব্যান্ড  মিউজিকে "রেনেসাঁ" এক উজ্জ্বল নাম। "রেনেসাঁ" মানে নবজাগরণ। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকে নতুন ধারা শুরু হয়। রোমান্টিক গানের পাশাপাশি বক্তব্যধর্মী গানের নতুন ধারার সঙ্গে"রেনেসাঁ" যুক্ত  হয় যা শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এই বিষয়ে নকীব খান বললেন: "গান হোক সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ার " - এই ছিলো আমাদের চাওয়া। রেনেসাঁর জনপ্রিয় বক্তব্যধর্মী  গানগুলোর মধ্যে আছে: " আজ যে শিশু,  তৃতীয় বিশ্ব, হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়, বাংলাদেশ তোমার বয়স হলো কত, একুশ শতকের গ্রাম বাংলা। শ্রোতাদের ব্যাপক আগ্রহ ও ভালোবাসা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।" এই দলের বেশ কয়েকটি ক্যাসেট রিলিজ হয়েছে এবং গানও তুমুল জনপ্রিয় হয়।

আঞ্চলিক গান 

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান নিয়েও কাজ করেছেন নকীব খান। তাঁর সুরে শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা " আঁরো দেশত যাইয়ু তুঁই ",   "ননাইয়া ননাইয়া কথা কই" এবং আসিফ ইকবালের লেখা " হতদিন হইয়ে দে বাড়িত ন যাইদ্দে" গানদুটো শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

ব্যান্ড  সংগীতের পাশাপাশি আধুনিক গানের ভুবনে নকীব খানের নামটি আজ ব্র‍্যান্ড । নকীব খানের গান মানেই অসম্ভব সুন্দর মেলোডিয়াস গান।

সংগীত জীবনের ৫২ বছর পূর্তিতে গায়ক, সুরকার, গীতিকার, বাদ্যযন্ত্র শিল্পী, সংগীত পরিচালক নকীব খানকে জানাই প্রাণের বাংলার পক্ষ থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।

ছবি: নকীব খানের ফেইসবুক থেকে

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199